.
মর্মাহত স্বামী
কয়েকদিন হইল ২য় বন্ধু একটা বিশেষ মোকদ্দমায় ১ম বন্ধুর উপর কাছারীর ভার দিয়া কলিকাতা গিয়াছেন।
সেদিন কাজ করিতে করিতে অনেক বিলম্ব হইয়া গিয়াছিল। বাসায় ফিরিয়া প্রথম বন্ধু দেখিলেন সমস্ত উঠানখানি অন্ধকার। দরজা দিয়া ঢুকিতেই হারিকেন আলোটি একটা দমকা বাতাসে নিবিয়া গেল। খোকাকে ডাকিলেন-না খোকা উত্তর দিল, খোকার মা উত্তর দিলেন।
বারান্দায় উঠিতে একটা বদনা পায়ের আঘাতে ছুটিয়া পড়িল।
শব্দ শুনিয়া পত্নী উঠিলেন। তিনি সন্ধ্যাকালেই খোকাকে লইয়া শুইয়া ছিলেন, এই উঠিলেন। ঝি কখন যে চলিয়া গিয়াছে, তাহা জানেন না।
১ম বন্ধু কহিলেন–বাতিটা লাগাও। পত্নী অতিকষ্টে জড়িত স্বরে উত্তর দিলেন–ম্যাচ বাক্সটি যে কোথায় আছে, তার ঠিক নেই।
“তাইতো এই ঝড় বাতাসের” … বলিয়া প্রথম বন্ধু সেই অন্ধকারের মধ্যে ফিরিলেন। কাছারীতে ফিরিয়া বিহারী সিংহকে ডাকিয়া বলিলেন–”তোমাকে একটু বাজারে যেতে হবে।”
বিহারী। কেন বাবু?
১ম–একটা ম্যাচ বাক্স আনতে।
বিহারী মনে মনে একটু হাসিল-তার মানে, “সে-কথা দিন থাকতে মনে ছিল না বাবু!”
বিহারী কহিল–”তা আমার ম্যাচবাক্সটাই নিয়ে যান। কাল দিনে কিনলেই হবে?”
প্রথম বন্ধু বিহারীর ম্যাচ বাক্সটি লইয়া বাসায় ফিরিলেন।
পত্নী আবার ঘুমাইয়াছিলেন। তাহাকে উঠাইয়া কহিলেন–এই ম্যাচ বাক্স এনেছি, বাতি ধরাও। কেন ঘুমিয়ে ছিলে? বসে বসে পড়তে থাকলেই হতো। বেশি ঘুমোলে শরীর খারাপ হয়। পড়া তো খুব ভালো। তুমি বসে বসে পড়তে–আর আমি যখন আসছি, আমার সাড়া পেলেই দরজা পর্যন্ত এগিয়ে এসে বলতে-’এসেছ, এস’! বলিয়া একটু প্রীতির হাসি হাসলেন।
পত্নী সে হাসির অর্থ বুঝিলেন না। কহিলেন–”আমার ওসব ভালো লাগে না।”
“কী ভালো লাগে না?-পড়তে?-না, আমায় দেখে আনন্দে অভ্যর্থনা জানাতে?”
“পড়তেও চাইনে–ও ‘ঠাট’ করতেও চাইনে–আমাদের মধ্যে ওসব কিছু নেই”
“পড়া খুব ভালো-নইলে তোমার জন্য এত কষ্ট কচ্ছি!”
“তোমার কষ্ট করা বৃথা–আমার মাথায় ওসব যায় না–তোমার ওসব কীর্তি কোনো মেয়েই জানে না।”
“পড়লে তোমার জ্ঞান হবে।”
“জ্ঞান দিয়ে আমার কী হবে?”
১ম–জ্ঞান হলে ভালো মন্দ বুঝতে পারবে, আমার সঙ্গে, লোকের সঙ্গে, পাড়া প্রতিবেশীর সঙ্গে ব্যবহার করতে হবে, সংসারের উন্নতি কিসে হবে, দাম্পত্যজীবন কীভাবে চললে সুখময় হয়, ধর্মাধর্ম, নারী-জীবনের বিশেষত্ব, নারীধর্ম, স্বামীর সহিত নারীর সম্বন্ধ এসব বুঝতে পারবে। মানুষ কিসে বিগ্ন পায়, ছেলেমেয়ের কিসে মঙ্গল হয় এসব বই পড়লে বুঝতে পারা যায়।
পত্নী। তুমি যে এত কথা ভাব, তা তো একটুও ভাবি নি। তোমার মনে যে এত কেন ‘মগজ’ তা তো একটুও জানি নে। আমি কি তোমার সংসার ছারেখারে দিচ্ছি? না, কারো ঘরে সিঁদ দিচ্ছি? কার কাছে অধর্ম করলাম? ইস, আমার মত মেয়ে আর একটা পেতে হয় না, আমার মত ‘মা’ একটা খুঁজে কেউ বের করুক দিখি? আমি যেমন মানুষের মন যুগিয়ে চলি, এমন আর কেউ চলবে না।
১ম–তুমি আমার কথাটা মন্দভাবে নিচ্ছ কেন? যাক, এখন খেতে দাও। ঘরগুলি অন্ধকার কেন? বাতি লাগাও। এই নাও ম্যাচ বাক্স।
ম্যাচবাক্স লইয়া চৌকির তলা হইতে হারিকেন বাহির করিয়া চিমনী খুলিয়া বাতি ধরানো হইল। চিমনীটা কালী ময়লায় ভরা।
রান্নাঘরে যাইতে পাতিলাটি পুড়িয়া বাতিটি নিবিয়া গেল। বাতিতে তেল ছিল না।
একটা মেটে ঘড়ায় অন্ধকারে খোকার মায়ের ধাক্কা লাগিল। ক্রোধে ‘দূর ছাই-মরে না‘ ইত্যাদি বলিয়া পত্নী হারিকেন হাত হইতে ফেলিয়া দিলেন।
সে রাত্র আর কাহারও খাওয়া হইল না। প্রথম বন্ধু কোনোমতে অন্ধকারে বিছানা হাতড়াইয়া শুইয়া পড়িলেন। এ যেন প্রতিদিন তীব্র হলাহল পান করিবার মতো অবস্থা হইয়া উঠিয়াছে। বন্ধু তাহাকে সহ্য করিয়াই যাইতে বলিয়াছে, হয়তো তাহার চিন্তাধারায় কিছু ভুল আছে। হয়ত তিনি তাহার জীবনের গভীর অবস্থা ঠিক বুঝিতে পারিতেছেন না। তাহাকে যদি এমনই অবস্থায় পড়িতে হইত, তিনি কিছুতেই স্থির থাকিতে পারিতেন না। প্রতি মুহূর্তে সর্পের বিষ দংশনে জর্জরিত হওয়া অপেক্ষা মরণই ভালো। এ যেন সর্পদংশন। অপেক্ষা অধিক জ্বালাময়। হয়ত অদৃষ্টে সুখ না থাকিলে, শত চেষ্টাতেও তাহা লাভ হইবে না। সুখময় দাম্পত্য জীবন তাহার ভাগ্যে নাই।
সংসারে সকল ক্ষেত্রেই কি সরল ব্যবহার ফলবান হয়? কোনো কোনো ক্ষেত্রে বেত্রাঘাত প্রয়োজন। প্রতিদিন হাড়ভাঙ্গা প্রহারের দ্বারাও এই শার্দুল-ভার্ব নারীর মতি স্থির হইতে পারে! নিজ সমাজ ব্যবস্থার উপর ধিক্কার জন্মিল। এই নারী যদি তাহাকে ভালো না বাসিতেই পারে, তবে তাহাকে জোর করিয়া তাহার সহিত কেন বিবাহ দেওয়া হইল? এত গর্হিত কাজ সমাজ কেন করিতে সাহস পায়! সে কি জীবন ভরিয়া একটা অনিচ্ছুক নারীর প্রতি বল প্রয়োগ করিয়া যাইবে–এতো বিবাহের নামে সত্য ব্যভিচার।
সেও কি ভালবাসিয়া এই নারীকে বিবাহ করিয়াছে? না–কখনও নয়। তবুও সে তো তাহাকে অশ্রদ্ধা করিতে চায় না। তাহাদের উভয়ের জীবনই হয়তো ব্যর্থ হইয়াছে। তা বলিয়া কি আবার নূতন করিয়া জীবনের অভিনয় হওয়া সম্ভব। যাহা হইবার তাহা হইয়াছে, ভাগ্যে সন্তুষ্ট থাকিয়া জীবনকে যথাসম্ভব সরল করিয়া লওয়াই তো বুদ্ধিমানের কাজ।