১ম–এর কি কোনো প্রতিকার নেই?
২য়–সমাজ নিজের গতিতে চলে। কোনো কথা সে গ্রাহ্য করে না। সমাজের চাপে। বহু মানুষের জীবন চূর্ণ হয়ে যায়।
১ম্যাক, ওসব কথার মীমাংসা পরে হবে। আমার সম্বেন্ধে কী বলছো?
২য়–তাঁকে এখানে নিয়ে এস। সর্বপ্রকারে তাকে ভালো করতে চেষ্টা কর। যদি সর্বপ্রকার মঙ্গল চেষ্টা করেও কোনো ফল না হয়, তার পর যা জান, তাই করো।
১ম–খরচপত্র সম্বন্ধে কী হবে?
২য়–আমি যে একশত টাকা বেতন পাচ্ছি, তাই থেকে তুমি ৫০ টাকা নেবে। বাকি টাকাতেই আমার খরচ চলবে।
মহম্মদপুরের জমিদার নীলকান্ত রায়বাহাদুর বর্তমানে যে ভদ্রলোকটি ২য় বন্ধু নামে পরিচিত হইতেছেন, তাঁহাকে নিজ জমিদারির ম্যানেজাররূপে রাখিয়াছেন। বেতন মাসিক ১০০ টাকা। ২য় বন্ধু এক সময়ে কলিকাতায় নীলকান্তের সহিত কলিকাতা সিটি কলেজে একই শ্রেণীতে পাঠ করিয়াছিলেন। ২য় বন্ধুর চরিত্রগুণে মুগ্ধ হইয়া নীলকান্ত নিজ জমিদারির সমস্ত কর্তৃত্ব তাঁহাকে দিয়াছেন। পূর্ববর্তী ম্যানেজার মহাশয়গণ প্রজার উপর অত্যাচার করতেন। বর্তমান ম্যানেজার অতি মহৎ প্রকৃতির লোক। বি. এ. পাস করিয়া ঘরে বসিয়াছিলেন। বন্ধু নীলকান্ত তাঁহাকে ধরিয়া আনিয়া নিজ জমিদারির ভার দিয়াছেন। বন্ধু নীলকান্ত বাবু জমিদার হলেও তাহার জীবন খুব উন্নত। প্রজাদের উপর কোনো প্রকার অন্যায় প্রাধান্য তাহার নাই। মানবসেবা এবং পৃথিবীর মঙ্গল করাই তাহার জীবনের উদ্দেশ্য।
১ম বন্ধু উত্তরে কহিলেন–তোমার এই অনুগ্রহের ভার আমার পক্ষে বহন করা কি খুব কঠিন হবে না?
২য়–আমি যদি সংসারী হতাম, তা হলে তুমি একথা বলতে পারতে। আমি সন্ন্যাসী ফকিরের দান গ্রহণ করাতে তোমার কি আপত্তি? যে আমার সেবা গ্রহণ করে, সে আমায় ধন্য করে।
১ম–শ্বশুর বাড়ি থেকে কী করে স্ত্রীকে বের করি?
২য়–বল, পশ্চিমে বেড়াতে যাই। দেশ ভ্রমণের নামে মেয়ে মানুষ খুব উৎসাহিত হয়ে ওঠে। বাড়ি নেবার কথা বলো না।
২য় বন্ধুর পরামর্শ মতো ১ম বন্ধু স্ত্রীকে যথাসময়ে কৌশল করিয়া শ্বশুর বাড়ি হইতে বাহির করিয়া আনিয়াছেন। কয়েকদিন এখানে-ওখানে ঘুরিয়া তিনি মহম্মদপুরে আসিয়াছেন।
স্ত্রী বাসায় আসিয়া বিশেষ অসন্তোষ প্রকাশ করেন নাই। কেন যে তাঁহাকে এমনভাবে এখানে আনা হয়, তাহাও তিনি কিছু জিজ্ঞাসা করিলেন না।
ম্যানেজার সহেব বন্ধুর বাসাতেই খাইবেন।
.
নারী-চিত্ত
২য় বন্ধু কহিলেন–বিপুল ধৈর্য চাই। অসহিষ্ণু হয়েছে কি, সমস্ত পণ্ড হয়েছে।
১ম–বড় কঠিন।
২য়–হাঁ কঠিন বৈ কি।-এর মতো কঠিন কাজ আর নেই। মানুষকে মহৎ ও মঙ্গলের পথে। আনতে হলে, এই হচ্ছে তার পথ। কোনো কোনো ক্ষেত্রে অসফল হলেও মানব-হৃদয়ের মঙ্গলের জন্যে আর দ্বিতীয় পথ নেই। ক্রোধ, ঘৃণা, নির্যাতন–এগুলি মানুষকে কখনও বড় করে না। সাময়িক উপকার হলেও এর ফল কখনও ভালো নয়।
১ম–তোমার উপদেশ আমি মাথা পেতে নিলুম। আমি এখনও ক্রোধ দমন করতে শিখি নি।
২য়–এত ক্রোধ হয় কেন?
১ম–যা আমার রুচিকে আঘাত করে, তা আমি সহ্য করতে পারি নে। বিভিন্ন রুচির মানুষ একসঙ্গে বাস করলেই কলহ হয়।
২য়–তা ঠিক।-একটা বিষয় বিবেচনা করতে হবে।
১ম–কী বিষয়?
২য়–আমাদের দেশের নারী মা-বাপ হারা পথের শিশু।–কেউ তাদেরকে শিক্ষা দেবার নেই–উন্নত সমাজের সংস্রব তারা পায় না। তাদের রুচি মার্জিত হবে কেমন। করে?
১ম–কিন্তু আমার দাবিকে কিছুতে ছাড়তে চাই নে।-এ আমার কাছে একেবারে অসহ্য।
২য়–সমাজ যখন নারীকে এমন করেই গড়ে তুলছে, তখন তুমি অসন্তুষ্ট হলে চলবে না। যে স্বামী পত্নীর উপর অসন্তুষ্ট, সে-ই কার্যক্ষেত্রে আপন ভগিনী ও কন্যার শিক্ষার ব্যবস্থা করে না। তুমি পিতা বা ভাই হয়ে যে অবহেলা কর, তার ফল স্বামীরূপে গ্রহণ করতেই হবে।
১ম–তুমি ভারি মোক্তারি করছ?
২য়–তোমার বেদনা আমি বুঝতে পাচ্ছি। অন্তত নারীর বাবা-মা যদি মেয়েদের একটিমাত্র শিক্ষা দেন, তা হলেই যথেষ্ট হয়।
১ম–সেটি কী?
২য়–সেটি বিনয় এবং বাধ্যতা। বিভিন্ন মানব-চরিত্র এবং জীবনের কর্মবৈচিত্র্য মনুষ্যকে জ্ঞানী এবং লোক-চরিত্র সম্বন্ধে অভিজ্ঞ করে তোলে। মেয়েরা বাল্যকাল হতে মৃত্যু পর্যন্ত একই ধরনের ২/৪টা মানুষ, যেমন, মা, বোন, চাচি-এদের মধ্যেই বেড়ে ওঠে। কলেজ বা স্কুলে অনেক মেয়ের সঙ্গে মেশবারও তার সুবিধে নেই, জীবনে তার ঘাত প্রতিঘাত নেই।–বৈচিত্র্য নেই। এই বৈচিত্র্যে মানবাত্মার রূপ ও সৌন্দর্য ফোটে। যেখানে ভাব ও বৈচিত্র্য নেই, সেখানে মানুষ আনন্দ পায় না। তাই বিবাহের কয়েক বৎসর পরেই। স্বামীরা বলে ওঠেন–কিছু ভালো লাগে না।
১ম–ঠিক কথা।
২য়–সঙ্কীর্ণ গণ্ডিতে আবদ্ধা মেয়েরা সঙ্কীর্ণ আবহাওয়ার মধ্যেই বাড়তে থাকে। তাদের জীবনে বৃহত্তর অনুভূতি নেই। গল্পের মধ্যে তাদের এই সব কথা হয়। যেমন, কী রান্না হয়েছে, স্বামী বা শ্বশুর কী গয়না দিয়েছেন। আমার ছোট খোকার বয়স ৭/৮ হবে। তোমার শাড়িখানির দাম কিছুই নয়। ওর চাইতে আমার ঢের ভালো শাড়ি আছে।-এই। সব রাবি কথা যা শুনলে যুবকেরা বিরক্ত হয়ে ওঠে।
১ম–তাই।-তুমি যে উপদেশ দিচ্ছ, তা যেন সাগর সেচে মানিক বের করার মতো কথা।
২য়–দেখই না চেষ্টা করে। কিছু কিছু পড়াতে থাক।