১ম বন্ধু–বুঝেছি। আমার মনে হচ্ছে ছেলেমেয়েদেরকে বাল্যকাল হতেই এইভাবে শিক্ষা দিতে হবে।
২য়–হ্যাঁ, সমস্ত সাংসারিক কার্যে যত বড় লোকই তুমি হও না, ছেলে-মেয়েদিগকে লাগিয়ে দাও। খবরদার, একটু সঙ্কোচ করো না। পরিশ্রম ও কাজের ভার দিয়ে তাদেরকে লোহার মতো শক্ত করে তোল। বিশ বৎসরের পূর্বে কখনও ছেলেমেয়েদেরকে বিলাসজীবনের স্বাদ গ্রহণ করতে দিও না। একবারে মোটা বস্ত্র, মোটা চাল, কঠিন শয্যা, সাংসারিক সমস্ত কার্যে তাদেরকে অভ্যস্ত করাও। কোনো লজ্জা করো না। যাদেরকে তোমরা লজ্জা করে থাক, তারা কাপুরুষ, দুর্বলহৃদয়; পরমুখাপেক্ষী, তাদের কোনো সম্মানজ্ঞান নাই, তাদের মনের স্বাধীনতা নাই।
এই সমস্ত কাজে ছেলেদেরকে কখনও নিষ্ঠুরের মতো অভ্যস্ত করাবে না। প্রেমে এবং নিজে তাদের সঙ্গে যোগ দিয়ে তাদের মনুষ্যত্ব গঠন করে তুলবে। সংযম অভ্যাসে বেশী জবরদস্তি ভালো নয়, তাতে তাদের মনুষ্যত্ব অর্জনে অশ্রদ্ধাও হতে পারে রূঢ় আজ্ঞা, ভর্ৎসনা, Despotism যতটা কম হয়, ততই ভালো।
১ম–কি কি ধরনের কাজ ছেলেমেয়েদেরকে অভ্যস্ত করাতে হবে?
২য়–গো-সেবা, গাভী-দোহন, ঘর-দ্বার ঝট দেওয়া, রান্না, পানি তোলা, ধান বের করা, চাল প্রস্তুত করা, রৌদ্রে দেওয়া, উঠান নিকান, বাগানের কাজ, কাপড় ধোয়া, কাঠ চেলা করা, বাঁশ ফাড়া, বেড়া বাঁধা, গাছ লাগান, গৃহস্থালীর দ্রব্যাদি প্রস্তুত করা, রোগীর সেবা ইত্যাদি।
১ম–সংসার চালানো সম্বন্ধে কিছু বল।
২য়–চাকুরের জীবন আদর্শ নয়। দেশের সকল মানুষই যে চাকরি করবে, তা হতে পারে না। যারা চাকুরী করে না তারা যে সম্মানের যোগ্য নয় এরূপ মনে করা বাতুলের। কাজ। কে একজন ডেপুটি বা দারোগা হলে যে স্বর্গে উঠেছেন, এরূপ মনে করাও বোকামি। একখানি ঘরের জন্য যেমন অনেকগুলি স্তম্ভ দরকার, তাদের কাজ বিভিন্ন স্থানে দাঁড়িয়ে আপন আপন কর্তব্য সম্পাদন করা–জাতির মানুষগুলিও তেমনি বিভিন্ন স্থানে দাঁড়িয়ে নিজেদের কর্তব্য সম্পাদন করবে। প্রত্যেক মানুষের, প্রত্যেক কাজের মূল্য এবং মর্যাদা আছে।
আমরা এখনও পতিত জাতি বলে চাকরির এত লোভ করি। এটা জাতি হিসাবে বিনষ্ট হবার কল্পনা। মানুষের মর্যাদা হয়-জ্ঞান, আত্মশক্তি এবং মানুষ্যত্বে। আর কিছুতেই নয়।
১ম–তা ঠিক।
২য়–জ্ঞান, আত্মার স্বাধীনতা এবং মনুষ্যত্বকে লক্ষ্য রেখে আমি বলি কৃষক হও, পল্লীর সামান্য দর্জি হও, জমি চাষ কর, বাগান তৈরি কর, তরকারির ক্ষেত কর। আমি বলি এই ই মানুষের আদর্শ এবং স্বাভাবিক জীবন। চাকরি জীবনের একটা অস্বাভাবিক অবস্থা।
১ম–তা ঠিক, কিন্তু পল্লীর যারা নিরীহ প্রকৃতির লোক তাদেরকে জব্দ করবার জন্যে সকল মানুষই প্রস্তুত। জমিদার, রাজকর্মচারী, গ্রামের মণ্ডল সবাই তাদের মাথায় কাঁঠাল ভাঙতে চায়। কেমন করে পল্লীর দরিদ্র গৃহস্থ হয়ে শান্তি লাভ করা যায়? ক্ষমতা চাই, দশজনকে বাধ্য রাখা চাই, টাকা চাই, মর্যাদা চাই, তা না হলে বাস করা যায় কী ভাবে? চাকুরেকে লোকে সম্মান করে, ভয় করে।
২য়–এই ভাবের মানসিকতা অনেকে পোষণ করেন। ফলে লোকে চাকুরী করে, অতি হীন পন্থায়, ঘুষ খেয়ে, চুরি করে বহু অর্থ সঞ্চয় করে। জমিদারি করে, ধরে, মেরে মানুষকে অপদস্থ করে প্রতাপ জাহির করে। জাতির জীবনে বহু পাপ রয়েছে, তাই সত্য জীবনের আদর্শ মানুষের প্রকাশ হচ্ছে না।
১ম–তা হলে কী করা যায়?
২য়–মিথ্যাকে কিছুতেই প্রশ্রয় দেওয়া যাবে না। যেখানে সত্য, সেইখানে শক্তি। বড় মানুষ হবার দুরাশা, জীবনের পক্ষে দুঃখজনক। যারা সত্যের সেবক, ধর্ম জিনিসটাকে যারা সত্য করে অনুভব করতে শিখেছে–তারা মিলিত হও, পাপ ও মিথ্যার হুমকিতে ভয় পেলে চলবে না। খোদা আছেন, তার পতাকা যারা ধরেছে, তারা লাঞ্ছিত হবে না। অত্যাচারী বড় লোক তার সমস্ত প্রতাপ নিয়ে দুমড়ে পড়বে, মানুষের জুলুম আর চলবে না। সহজ সত্য জীবনের জয় হবেই।
১ম–যা বলছিলে তাই বলো কীভাবে সংসারে আয় হতে পারে? পরিবারে শান্তি সুখ বাড়ে।
২য়–সংসারে যা নিত্য প্রয়োজন, তার প্রায় সবগুলিই একটু কষ্ট স্বীকার করলে বাড়িতে তৈরী করে নেওয়া যায়। কেবল আলস্যবশত মানুষ নানাবিধ অভাবে জর্জারিত হয়। মাঠে যদি ধান হয়। তবে বাড়িতে তরকারি হবে না কেন? এ জিনিসটা কেনবার দরকার? দুটো বেগুনের গাছ লাগিয়ে রাখলে সারা বছর বেগুন ধরে, অথচ কুঁড়েমি করে প্রত্যেক হাটেই পয়সা নিয়ে তরকারিওয়ালার সামনে যেয়ে দাঁড়াতে হয়। বেশ করে বেড়া দিয়ে নানাবিধ তরকারী গাছ, লঙ্কা, হলুদ, আদা, পেঁয়াজ এই সব লাগিয়ে দাও। বাড়ির চারধার দিয়ে মানকচু, ওল, কাঁচাকলা লাগাও। বাবু হয়ো না; নিজের যদি দরকার না হয়, তবে কাউকে দিলে তো তার উপকার হয়–খোদার দেওয়া হাত-পা; এবং গায়ের বলকে নিরর্থক করে দেওয়া বড়ই অন্যায়। বাড়ির চারধারে জায়গা থাকলে অসংখ্য গুবাক ও নারিকেল গাছ লাগিয়ে দেবে।
১ম–বাঁশের ঝাড়ে তো বেশ দুপয়সা আয় হয়?
২য়–হ্যাঁ, তবে বাড়ির কাছ বাঁশের ঝাড় ভালো নয়। যেখানে বেশী বাঁশের ঝাড়, সেখানে মানুষ বাঁচে না। দূরে কোনো স্থানে ২/১ ঝাড় বাঁশ থাকলে সংসারে অনেক সাহায্য হয়।
১ম–আর কী কী জিনিস তৈরি করা যায়?