১ম–গৃহস্থালীর মূল উদ্দেশ্য কী? গৃহস্থালী শব্দটির অর্থ কী? আমায় বুঝিয়ে বল।
২য়–গৃহস্থালীর অর্থ এমন কতকগুলি আয়োজন যার ফলে কতকগুলি লোক এক জায়গায় বাস করে জাগতিক এবং শরীরের সমস্ত অভাব পূরণ করতে পারে। পার্থিব অভাব সম্বন্ধে নিশ্চিন্ত হয়ে তারা খোদার কাজ করতে পারে–মানব সমাজের মঙ্গল চেষ্টা করতে সমর্থ হয়।
১ম–এই অভাব পূরণের কাজ কী? কী উপায়ে এই উদ্দেশ্য সিদ্ধ হতে পারে? আমার মনে হয় উচ্চ কোনো মানুষ গৃহস্থালী করে না।
২য়–মানুষের মন এত অবনত হয়ে পড়েছে–তাহাদের চিন্তা এত সঙ্কীর্ণ হয়ে পড়েছে যে, মানুষ খাবার জন্যেই বেঁচে থাকে, চিন্তা করে, চেষ্টা করে, লেখাপড়া শেখে, সংগ্রাম করে। মানুষের সমস্ত শক্তি শুধু পেটের জন্যে ব্যয়িত হচ্ছে। মানুষের জীবনের যে একটা বড় উদ্দেশ্য আছে, তা কেউ কল্পনা করে না। মানুষ যে উপাসনা করে, আল্লাহ্ আল্লাহ্ করে, তছবীহ্ টেপে কেবল অন্ন ও অর্থের মৃদু মধুর ঝুনু ঝুনু শব্দ শোনবার জন্যে। কোনো জাতি বিনষ্ট হবার পূর্ব লক্ষণ হচ্ছে এই। পেটের জন্যে মানুষ যে কেন এত ভাবিত ও আকুল হয়, তা বোঝা যায় না। যে পরিবার শুধু পেটের জন্য ব্যস্ত, মানুষ্যত্ব ও সত্যার্জিত, জাগতিক গৌরবের জন্য লালায়িত, জীবনের উচ্চতর সার্থকতার কোনো ধার ধারে না, সে নিকৃষ্ট পরিবার। সে পরিবারকে কতকগুলি পশুর আড্ডা বললে কোনোই দোষ হয় না।
১ম–জীবন সংগ্রাম কি খুব কঠিন হয়ে ওঠে নি?
২য়–এক রত্তি নয়। মনুষ্য যখন ধর্মহীন হয়, পতিত হয়, তখনই সে চতুর্দিক অন্ধকার দেখে, রাতদিন পেটের কথাই চিন্তা করে। সম্মান নষ্ট হবার ভয়ে বহু মানুষ ইচ্ছা। করে অপরিসীম দুঃখ ভোগ করে। সম্মান জিনিসটা কী? যে সম্মান মনুষ্যত্ব ও সত্যবর্জিত সে সম্মান সম্মান নয়। মানুষ জানে না, সম্মান কী? পেটের জন্যে যদি মানুষকে এত চিন্তা করতে হয়, তা হলে খোদা মিথ্যা, তার ধর্ম মিথ্যা। মানুষ ইচ্ছা করে নিজেদের দুঃখ বাড়ায়। খোদাকে ভুলেই মানুষের এই দুর্দশা। কী হবে রেশমী কাপড়ে, সাততলা দালানে, গহনায়, দাস-দাসী, পাইক-পেয়াদায়, মেয়ের ভালো বিয়েতে-যদি মিথ্যা, হীনতা, নীচতা, চৌর্যবৃত্তি আশ্রয় করে এইসব দূর করতে হয়। কতকগুলি লোকের একটা সর্বনাশা ধারণা হয়েছে–”আমলের দরকার নেই, শুধু নামাজ-রোজার কেতা বজায় রাখলেই খোদার পাওনাটুকু শোধ দেওয়া গেল, ধর্মজীবনের কর্তব্যগুলি পরিসমাপ্ত হল। এই অতি ভয়ানক ভুল চিন্তাধারায় সমাজের প্রভূত অনিষ্ট হবে। মানুষ ধর্ম, সত্য ও মনুষ্যত্ব বিসর্জিত হয়ে অতি শোচনীয় দুর্গতির ভারে বিনষ্ট হবেই।
২য়–আমাদের তথাকথিত ভদ্রলোক হবার দরকার নেই। বাবু হবার কোনো দরকার নেই। আজ সবার লক্ষ্য চাকরি। একটা intellect-এর prostitution ছাড়া আর কিছু নয়। জ্ঞান লাভ করতেই হবে সেটা কি চাকরির জন্যে? মানুষের কী হীন চিন্তা, সমস্ত সমাজটার কী শোচনীয় angle মতো vision। মর্যাদাজ্ঞান এদের একটুও নেই। লেখাপড়া শিখে কৃষি, বাণিজ্য, শিল্প, ব্যবসায় এসব করলে কী ক্ষতি? না, না, সবাইকে ‘বাবু’ হতে হবে! আর ব্যবসায় করলেও বাবুদের পাঁচ হাজার টাকা মূলধন চাই!-নইলে ব্যবসা কী করে করা যায়! ছোট লোকের মতো কেন চাউলের বস্তা পিঠে করে এক জায়গায় নিলে কী ক্ষতি? চৌর্যবৃত্তি অপেক্ষা সেটা সম্মানজনক। সাদা কাপড়পরা চোর নামাজী অপেক্ষা একজন মজুর, মিস্ত্রী, কর্মকার, দরজি, তেলি বা জোলা ভালো। ভদ্রলোক হবার যে উৎকট নেশা দেশের লোকের মনের মাঝে চেগিয়ে উঠেছে, সেই জন্যেই জীবনসংগ্রাম এত কঠিন হয়ে পড়েছে। উকিল বাবুর তোষামোদকারী মিথ্যাবাদী মহুরী হওয়ার চাইতে, একটা জুয়াচোর জমিদারি সেরেস্তায় নায়েব হওয়ার চাইতে, একটা দুর্বৃত্ত রাজকর্মচারি হওয়ার চাইতে, একটা সুদখোর চেয়ারে বসা বাবু হওয়ার চাইতে, বাজারে দাড়ি পাল্লা ধরে চাউল বিক্রয় করতে বসা ভালো, জুতা মেরামত করা ভালো, নাপিত হওয়া ভালো, দপ্তরী, কুমোর, কামার, দরজী হওয়া ভালো। যারা তথাকথিত ছোট কাজ করে তাদের পয়সার অভাব নেই। পয়সার অভাব হয় চোর ভদ্রলোক বাবুদের। তাদের ধর্মজীবন একটা ভণ্ডামি পোশাক-পরিচ্ছদে বেশ্যাদের আড়ম্বরের মতো। লেখাপড়া শিখে মানুষ অপবিত্র মিথ্যা জীবন যাপন করবার জন্যে যে এত লালায়িত কেমন করে হয়, তা বুঝি নে!
১ম–যারা এই সমস্ত ছোট কাজ করে, তারা বড় নীচ।
২য়–সে দোষ কাজের নয়, সে দোষ শিক্ষার। শিক্ষা নাই বলেই তারা মিথ্যাবাদী। এবং নীচ। কাজের কোনো দোষ নেই।
১ম–চাকরি জিনিসটা কি একেবারেই খারাপ?
২য়–জীবিকার জন্য চাকরি না করাই ভালো।
১ম–কী করতে হবে?
২য়–কৃষক হও, মজুর হও।
১ম–ভদ্রলোকেরা কি তা পারে?
২য়–মানুষের আদি পিতার জীবন মজুরের। তার ছিল দুখানি হাত, এই মাটি, আর একটি সুখ-দুঃখের বন্ধু। মানুষের জন্য এই-ই যথেষ্ট মূলধন। হালকর্ষণ এবং মজুরের জীবন মানুষের প্রথম ও সত্যরূপ। এ দুটিকে কখনও অশ্রদ্ধা করতে নেই। অন্য কাজ করা যে দোষের তা বলছি তা বলছি নে। আমি বলি, এ দুটি মানুষের নিজস্ব ব্যবসায়কে অস্বীকার করে কেন সে দুঃখ ডেকে আনে? তুমি বলছ, ভদ্রলোকে এসব কঠিন কাজ পারে না। ঠিক বলেছ। ভদ্রলোক যে, তাকে কানমলা খেয়ে বিনয়ের নামে চুপ করে থাকতে হয়। তার ভাগ্নিকে মানুষ যখন গলা ধাক্কা দেয়, তখন তাকে মৌন হয়ে থাকতে হয়। তাকে যখন মানুষে লাথি মারে, তখন তাকে হাঁ করে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। মানুষ মাংস খেয়ে যখন অস্থি ফেলে দেয় তাতেই তৃপ্ত থাকা ভদ্রলোকের কাজ। তিনি ননীর পুতুল, এমন কি আত্মরক্ষার ক্ষমতা নেই, গায়ে মাংস নেই, অর্ধ মণ জিনিস হাতে করলে হাঁপিয়ে পড়েন। একটু রৌদ্রে বেরোলে মোমের মতো গলে যান। মাটিতে পা লাগলে পা ফেটে রক্ত বের হয়! তিনি চাকর-নফর দিয়ে পা, গা টেপান, মিনিটে মিনিটে পান খান, সাত হাত হুঁকাতে তামাক সেবন করেন, খেলে কিছু হজম হয় না তবুও খান, কেউ ধাক্কা মারলে চিৎ হয়ে পড়েন, তার কাজ তোষামোদ, শঠতা, ধৈর্য এবং ফাঁকি-ভদ্রলোকের অনেক গুণ আছে! এই সব নবাবী ভদ্রতা ছেড়ে দিতে হবে। আজকালকার এই সব অনুভূতির যুগে ভদ্রলোক মানে কুকুর, ভীরু, কাপুরুষ, দুর্বল, শঠ, মিথ্যাবাদী, ভণ্ড ননীর পুতুল নয়–সে কর্মী, তেজস্বী, কখনও মজুর, কখনও মালিক, সে সত্যপ্রিয়, সাহসী, কৃষক, শিল্পী, মিস্ত্রী, সৈনিক, সেনাপতি। প্রত্যেক মানুষকে–সে যদি পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ নরপতি হয়, তাকে প্রথমে মজুর, হতে হবে, তাকে কষ্টসহিষ্ণু হতে হবে। কঠিন পরিশ্রম এবং Discipline তার মাংসপেশীকে সরল ও সুদৃঢ় করে তুলবে। পাশ্চাত্য জাতিরা আজ এই কথা বুঝেছে বলে তারা পৃথিবীকে শাসন করছে। মানুষ যেদিন মজুরকে ঘৃণা করবে, সেদিন সে জগতের গোলাম হবে, যেমন আমরা হয়েছি।