স্বামী যেমন পত্নীকে যত্ন করবেন, আদর করবেন, সম্মান করবেন, পত্নীরও কর্তব্য স্বামীকে সর্বপ্রকারে প্রেম করেন, স্বামীতে বাধ্য থাকেন, তার অন্তরের ভিতর প্রবেশ করেন। তার কীসে সুখ হয়, সে কথা বলবার পূর্বেই অনুভব করে কাজ করেন। স্বামী যদি নিতান্তই ইতর, দুর্বৃত্ত, নরপিশাচ এবং শয়তান হয়, তবে তাকে নারী যদি ত্যাগ করেন, দোষ দেওয়া যায় না।
.
আদর্শ পরিবার
২য় বন্ধু কহিলেন বন্ধু! যে পরিবার সত্যবর্জিত, সে পরিবার অশান্তির কেন্দ্র। পরিবারের লোকেরা যদি সব সময় সত্যভাবে চলবার আকাঙ্ক্ষা না রাখে, পরস্পরে মিথ্যা ব্যবহার করে, একজন আর এক জনের সঙ্গে নিষ্ঠুরাচরণ করে, কারো সঙ্গে কারো প্রেম নেই, কারো প্রতি কারোর সহানুভূতি নেই, সে পরিবার অশান্তির আকর। একজন আর একজনকে ক্ষমা করতে হবে, পরস্পরে একটা সুগভীর প্রেমবন্ধনে আবদ্ধ থাকবে, যে কর্তা হবে সে পরিবারের সবাইকে ভালোবাসবে। প্রেমের যে শাসন, সেইটিই উত্তম। অহরহ কলহ বিবাদ, নিষ্ঠুর ব্যবহার এসব সত্যবর্জিত পরিবারের লক্ষণ।
১ম–সত্যবর্জিত অর্থ কী?
২য়–মানুষের জীবন যান সত্যকে লক্ষ্য করে চলে না তখন তার লক্ষ্য সত্য জীবন নয়, তখন কোনো ধর্ম-কর্ম তাকে ইহজীবন এবং পরজগতের দুঃখ হতে রক্ষা করতে পারে না। তাদের জীবন কেবল বিড়ম্বনাময়, দুঃখ ও অশান্তিতে পূর্ণ। পরিবারে অশ্লীল বাক্য উচ্চারিত হওয়া বড়ই অন্যায় এবং আপত্তিজনক। কোনো পরিবারে অভাবের দরুন অশান্তি হয়, পরস্পরে ভাইতে ভাইতে, পিতা-পুত্রে মনোমালিন্য উপস্থিত হয়। অভাবের জন্য একে অন্যের পেছনে কথা না বলে সকলে মিলে একসঙ্গে কী করা কর্তব্য এ বিষয়ে পরামর্শ করে কাজ করাই ভালো। পরিবারে Despotic Rule মোটেই ভালো নয়। Tyrant Father of Tyrant eldest brother যারা পরিবারে কনিষ্ঠদেরকে একেবারে নির্মলভাবে চেপে রাখতে চান, কারো ব্যক্তিত্বকে স্বীকার করতে চান না, পুত্রের সঙ্গেও সন্ধি করে চলতে হবে। এটিই খোদার অভিপ্রেত এবং ভদ্রতা। যে পরিবারে সগ্রন্থ পাঠ, মহাপুরুষদের জীবনী, কোরান-হাদীসের আলোচনা হয় না, সে পরিবারের মঙ্গল এবং উন্নতি হয় না, চিত্ত তাদের মার্জিত হয় না, শুধু নামাজে না বুঝে খোদার কালাম আবৃত্তি করলে আধ্যাত্মিক কোনো মঙ্গল হয় না, মনের কপাট খোলে না, আল্লাহর বাক্যের কোনো সার্থকতা হয় না। তারা যেমন আছে চিরকালই তেমন থাকে। প্রত্যেক মুসলমানের কর্তব্য তারা বুঝে হাদীস শরীফ পাঠ করে, নইলে মুসলমান পরিবারের বিনাশ অনিবার্য। পবিত্র হাদীস শরীফে মানুষের সর্বপ্রকার মঙ্গলের কথা লেখা আছে। মানবাত্মার উন্নতিতেই মনুষ্য শক্তি, শান্তি, ধন, কল্যাণ লাভ করে। তা অর্জন করবার কোনো কঠিন আদেশ কেন দেওয়া হয় না, তা জনি নে। না বুঝে চিরকাল নামাজ পড়লে মানুষের আত্মোন্নতি কী করে হবে? আত্মা নিত্য নূতন বল সংগ্রহ করবে, এজন্য পরিবারে হাদীস কোরানের আলোচনা হওয়া নিতান্ত দরকার। এটা ফরজ করতে হবে। এ না করলে মুসলমান পরিবারের কোনো কল্যাণ নাই নাই নাই। দেখ মোনাজাতটা পর্যন্ত না বুঝে সম্পন্ন হয়। পাপী আল্লাহর কাছে ক্রন্দন নিবেদন (মোনাজাতটা) পর্যন্ত না বুঝে করা হয়। কী ভয়ানক কথা! মুসলমান সমাজে কোনো সত্যনিষ্ঠ সাধক, মহাপ্রেমিক, মহাপুরুষ জন্মগ্রহণ করবার কোনো পথ নেই, যেহেতু আল্লাহ্ সমস্ত বাক্য-তার রসূলের লোহার সিন্দুকে আঁটা। তা পড়বার (বুঝে পড়বার), ভাববার, নিজস্ব করবার, চিন্তা করবার কোনো দরকার নইে। কী ভয়ানক, কী সর্বনাশের কথা! যে পবিত্র জ্ঞানভাণ্ডার আমাদেরকে জীবনের প্রতি মুহূর্তে জীবনশক্তি, রস, চিন্তা, চরিত্রবল দেবে তারই কোনো আলোচনা নাই–কেবল আবৃত্তি, কেবল প্রাণহীন আবৃত্তি। আমাদের বিনাশের জন্য চরম দুঃখ অপেক্ষা করছে।
এই সময় মগরেবের নামাজ পড়িবার সময় হইল, দুই বন্ধু ওজু করিয়া নামাজ পড়িতে গেলেন। ১ম বন্ধু এমামতি করিলেন। ফরজ তিন রাকাত পর দ্বিতীয় বন্ধু কহিলেন-বন্ধু যদি; আমরা আন্তরিকতার সহিত বুঝে শুধু ফরজ নামাজ পড়ি, তাই যথেষ্ট হয়। নামাজের সংখাধিক্যে খোদাকে পাওয়া যাবে না, অনুভূতি এবং প্রভুকে চিত্তে ধারণ করাই পরম কথা। প্রেম ও সত্যই তার প্রকাশ। তার বন্দনার অর্থ সত্যময় হওয়া–প্রেমিক হওয়া।
১ম–বন্ধু সুন্নত শেষ করিয়া কহিলেন–ভাই, বন্ধু হলেও তোমার কাছে আমি মূর্খ ছাড়া কিছুই নয়। এক্ষণে আমি ইচ্ছা করি তুমি মাতৃভাষায় মোনাজাত কর, যাতে আমার মনে ধর্মভাব জাগে। মোনাজাত শেষ হলে আমার আত্মা যেন আল্লাহর পথে একটু অগ্রসর হয়, যেন একটু উন্নত হয়।
২য়–বন্ধু হাত উঠাইয়া প্রার্থনা করিলেন–”প্রভু! তুমি ইহজগৎ এবং পরজগতে আমার মঙ্গল বিধান কর। তোমার শাস্তি হইতে আমাদিগকে রক্ষা কর। আমাদের পাপ তুমি ক্ষমা কর। মিথ্যার উপর আমাদিগকে জয়যুক্ত কর। হে প্রভু, তাহাতেই যেন আমরা গৌরব করি। পার্থিব প্রভাব, বল, সম্পদ এবং অর্থে আমরা গৌরব না করি। হে প্রভু আমাদিগকে কাফের করিও না-যেহেতু তাহারা মিথ্যা ও পার্থিব বিষয়ে গৌরব করে। হে নাথ, আমাদের পাপ তুমি হরণ কর, যেন আমাদের রসনা অপবিত্র না হয়। যেন আবৃত্তি করিয়া আমাদের কর্তব্য শেষ না করি, যেন তোমাতে আমরা পরিপূর্ণ হই। আমাদিগকে সর্বপ্রকারে নির্মল এবং শুদ্ধ কর, যেহেতু অপবিত্র আত্মায় তোমার আসন হইবে না। দয়াময়, আমাদিগকে শয়তান হইতে রক্ষা কর–তাহা মিথ্যা, ক্রোধ এবং অবিনয়। আমাদিগকে মানুষ কর, তুমি আপন হাতে আমাদিগকে জাগাও। যেন সর্বত্র তোমাকে প্রচার করি। সমস্ত মনুষ্য হৃদয়ে তুমি তোমার রাজ্য বিস্তার কর। সমস্ত মানবচিত্তে তোমার আসন প্রতিষ্ঠিত হউক, যেন তোমারই জন্যে বাচিয়া থাকি, যেন সর্বত্র তোমাকে প্রচার। করি। মনুষ্যের সহিত ব্যবহারে আমরা যেন কাহাকেও বিঘ্ন না দেই, যেন সকলকে প্রেম করি, যেন প্রতিশোধ না লই। যেন শত্রুকেও প্রেম করি, আঘাত যদি করি, যেন তোমারই জন্যে করি। হে প্রভু, আমাদের জিহ্বা তুমি সংযত কর যেন মিথ্যা কথা আমরা না বলি। যেন সমস্ত কার্যেই, সমস্ত বাক্যেই তুমি থাক। আমাদিগকে দিন দিন মহৎ হইতে মহত্তর কর। যেন কাহারও উপর অত্যাচার না করি, যেন মনুষ্য দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলিয়া অভিশাপ না দেয়। হে প্রভু অন্নহীনকে অন্ন দাও, শয়তানপ্রাপ্তকে উদ্ধার কর। যেন মর্ত্যে তোমার দূত হইতে পারি এবং স্বর্গে তোমার সহিত বাস করি।–হে নাথ, যেন জগতের জন্য আত্মা বিক্রয় না করি। আত্মাকে হারাইয়া জগৎ লাভ করিয়া কী লাভ? আমাদিগকে পশু পরিও না। আমরা যেন কখনও ধার্মিকতার বড়াই না করি, যেন পুবৃত্ত ও নরপিশাচের মঙ্গল কামনা করি। যাহারা আমাদিগকে আঘাত করে, তাহাদিগকে যেন ভালোবাসি। আমাদিগকে সহিষ্ণুতা দান কর। যেন আত্মা হইতে প্রার্থনা করি, যেন প্রতিবেশীকে ভালোবাসি যেন কাহারও প্রতি রূঢ় বাক্য প্রয়োগ না করি, পাপের উপর আমাদিগকে জয়যুক্ত কর।