১ম–রাত্রের শিশুকে স্বতন্ত্র শোয়ালে কি সে বাঁচে, মা কি করে কাঁদা মাত্র ঘুমের মধ্যে শিশুর কাছে একশ’বার যেয়ে উপস্থিত হবে?
২য়–না, তা যাবার মোটেই দরকার নেই। খোদা তার সৃষ্টিতে কোনো অবিবেচনার পরিচয় দেন নাই। মূর্খ মেয়েরা শিশুকে যতবার ইচ্ছা, ততবারই দুধ দেয়-বেদনা পেলে, পেটে ব্যথা হলে, জ্বরে, অশান্তিতে, গরমে বা যে কোনো অসুবিধাতে কাদামাত্র মুখে মাইটি ভরে দেবে, এটি যারপরনাই মূর্খতা। শিশুদের রাত্রিতে দুইবারের অধিক দুধ খাওয়ানো নিষেধ। সারা রাত্রি তার মুখে মাই দিয়ে বুকের কাছে রাখবার কোনো দরকার নেই। শিশুদের দুধ দেবার মোটামুটি একটা নিয়ম বলে দিচ্ছি। ২১ দিন পর্যন্ত শিশুদেরকে প্রতি দু’ঘণ্টায়, দিনে-রাত্রে ১৩ বার দুধ দেবে–রাত্রিতে মাত্র দু’বার। ১ মাস হতে ২মাস পর্যন্ত দিনে রাত্রে ৭/৮ বার খাওয়াবে-রাত্রে মাত্র ১বার দেবে। তার পর এক বৎসর পর্যন্ত দিনে রাত্রে ৬/৭ বার, রাত্রে মোটে কিছু খাওয়ানোর দরকার নেই।
১ম–বটে, এতো কিছু জানতাম না। আচ্ছা মাতৃদুগ্ধ ভালো, না গো-দুগ্ধ ভালো।
২য়–মাতৃদুগ্ধই ভালো, যাদের তাতে আপত্তি আছে, তারা গোদুগ্ধ হাল্কা করে খাওয়াবেন, তবে শিশুর জন্মের ৫/৭ দিন পর্যন্ত মায়ের দুগ্ধই দিতে হবে।
১ম–স্বামী-স্ত্রীর ব্যবহার সম্বন্ধে আরও কিছু বল।
২য়–পত্নী স্বামীর বিশেষ অসন্তোষ উৎপাদন করে সাধুতা বা সংযম সম্বন্ধে কোনো পক্ষের বেশি বাড়াবাড়ি বা গোড়ামি ভালো নয়। একটু বুদ্ধিমানের মতো কাজ করলেই দাম্পত্য জীবনে কোনো বিঘ্ন আসে না। উভয়ের জীবন সরস এবং মধুময় হয়। পত্নীতে যথাসম্ভব কম যাবে। যত সংযম অভ্যাস করতে পার, ততই উভয় পক্ষে ভালো। শরীরটা একবার বাঁধা হয়ে গেলে আর বিশেষ ভয় থাকে না।
১ম–লোকে ছোট ঘরের মেয়ে আর বড় ঘরের মেয়ে বলে এর মানে কী? সবারই তো একই জিনিস? রাজরানীরও যা আছে, একজন কুলী রমণীরও তাই আছে।
২য়–না তা ঠিক নয়। নারীর রূপ বা আকর্ষণ শুধু তার আছে নয়। সবারই এক জিনিস আছে সত্য, কিন্তু তাই ধরেই নারীত্বকে পরিমাণ করলে চলবে না। নূরজাহান, মমতাজ, মিশরের রানী ক্লিওপেট্রা। এঁদের মত শত শত সুন্দরী জগতে আছে–কিন্তু খোদা তাদের মনের বিশিষ্ট সৌন্দর্য, তাদের ব্যক্তিত্বের বিশিষ্ট গৌরব, তাদের রূপের মহিমা দিয়েছেন রুচি, বাক্য, ভাব, বংশমর্যাদা, স্বভাব, ব্যক্তি, বিশেষ ক্ষমতা এবং মানসিক সৌন্দর্য নারীকে শ্রেষ্ঠ, রূপময়ী এবং গরীয়সী করে। নারী অঙ্গের নিজস্ব মূল্য খুব অল্প।
১ম–এই জন্যেই স্ত্রী-শিক্ষা প্রয়োজন–তার রুচি, বাক্য, ভাব, স্বভাব, ব্যক্তিত্ব, ক্ষমতা এবং মনকে মার্জিত এবং বিকশিত করে তুলতে হবে–এগুলি বাদ দিয়ে নারী কিছু নয়।
২য়–তাই ঠিক।
১ম–শুনেছি ছেলেমেয়েদের চেহারা অনেকটাই মাতার মানসিক সৌন্দর্যের উপর নির্ভর করেন।
২য়–হ্যাঁ তাই। তবে বাহিরের চেহারায় কিছু আসে যায় না। অনেক সুদৃশ্য নর-নারী আছে, যাদের মন খুব অপবিত্র। তাদের সৌন্দর্য্যে মানবসমাজের কি কল্যাণ হয়–বরং মনুষ্যসমাজকে তারা তিক্ত করে তোলে। সৌন্দর্য বিধাতার দান-এ একেবারে অশ্রদ্ধার জিনিসও নয়। নারীকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখবে। শয্যাগৃহে উত্তম উত্তম ছবি ঝুলিয়ে দেব। অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় কোনো অশ্লীল এবং ক্রোধপূর্ণ বাক্য শোনাবে না। এ অবস্থায় পবিত্র খোদার ভাবপূর্ণ সঙ্গীত, গজল শোনাবেফলে সন্তান রূপবান, সাধু-চরিত্র হবে। শুভ্র সুন্দর ফুল, নবীন তৃণ ও লতাপত্র আচ্ছাদিত সবুজ ক্ষেত্র, ঘরের জানালা দিয়ে সর্বদা নারীর নয়নসমক্ষে পড়া চাই।
নারী একটি ক্ষেত্র ছাড়া আর কিছুই নয়। এই পবিত্র ভূমিতে মনুষ্যরূপ অমৃত বৃক্ষের উদ্ভব হয়। এই পবিত্র ভূমির জন্য যত্ন আবশ্যক–এই মহীতল হতে মনুষ্যরূপী মহাযোগীবর জাগ্রত হন। নারী ধন্য!
.
নারীর প্রেম
২য়–পত্নীকে কাজেও বলিও না, হুকুমও করিও না-যেহেতু নারী অতিথি এবং তাকে প্রেম করেছ। নারীর কর্তব্য সে আপন স্বামীকে নির্লজ্জের ন্যায় প্রেম করে–যেন মনুষ্য তাকে বেহায়া বলে গালি দেয়–যেন তাকে সকলে বলে এই মেয়েটি স্বামীহাজতে। বস্তুত স্বামীহাজতে হওয়াই হচ্ছে সতী নারীর লক্ষণ।
১ম–কিন্তু সমাজের যা অবস্থা, তাতে দাম্পত্য প্রেম হওয়া একপ্রকার অসম্ভব। কন্যা। যদি স্বামীর নিন্দা করে, তার প্রতি অবজ্ঞা প্রদর্শন করে, তা হলে মা-বাপ ভাবে আমার। মেয়ে আমাদেরই আছে। যদি স্বামীকে প্রেম করে, তাকে মুখে এবং কার্যে প্রেম করে, তা হলে সবাই বলবে–মেয়েটা ধেড়ে। ঠিক তেমনি ছেলে যদি বিয়ের পর পত্নীকে ভালোবাসতে চায়, তা হলে পিতা মাতা, ভগ্নী সবাই ভাবেন আমাদের ছেলে পর হয়ে। গেছে, কোথা থেকে একটা আপদ এসে আমাদের ভাই অথবা ছেলেটাকে পর করে নিয়ে গেল। কেউ কেউ মনে মনে দারুন ঈর্ষা পোষণ করেন এবং সুযোগ পেলেই বউকে বিধতে। চেষ্টা করেন। ছেলে যদি বউকে নিন্দা করে, তাকে পদে পদে অপ্রস্তুত করে, তা হলে সে। ছেলের প্রশংসার সীমা থাকে না।
২য়–তুমি বড় গুরুতর কথা বলেছ। বাস্তবিকই সমাজে এরূপ হয়ে থাকে, কিন্তু যে পরিবারে এমনটি হয়, সে পরিবার অভিশপ্ত। প্রেম অপার্থিব পদার্থযুবক-যুবতীতে যথার্থ প্রেমের সঞ্চার দেখলে তাতে আনন্দিত হওয়া উচিত। যে তা দেখে ঈর্ষা পোষণ করে, সে নীচাশয় ছাড়া কিছু নয়। বলতে কি, আমাদের দেশে স্বামী-স্ত্রীতে যথার্থ প্রেম নাই–যদি তা থাকতো, তা হলে অতি অল্প সময়ে জাতির মঙ্গল হতো। প্রেম নাই বলেই এত অশান্তি, দুঃখ অভাব, চরিত্রহীনতা। পুত্র এবং পুত্রবধূতে যাতে গভীর প্রেম সঞ্চিত হয়ে ওঠে বরং তার চেষ্টা করা উচিত। কালক্রমে তাদের পরস্পরকে ভালোবাসার পথে বিঘ্ন জন্মাতে নাই–সেটা ছেলমেয়েদের প্রতি এক প্রকার নির্মম অত্যাচার, মুরুব্বী হয়েছ বলে যে কিছু বিবেচনা করবার নেই, কোনো কাজে কোনো ভুল নেই–এমনটি মনে করা ঠিক নয়। ছোটর প্রতি ব্যবহারে মুরুব্বীদের সতর্ক হওয়া উচিত, যেন ছোটদের উপর কোনো অত্যাচার না হয়। এর ফলে ছেলেদের সঙ্গে বিচ্ছেদ হয়। আর একটা কথা–যুবকদের প্রাণে স্বামী-স্ত্রীর সম্বন্ধ নিয়ে একটা নুতন চিন্তা এসেছে। তারা বৌকে আর কামের সামগ্রী মনে করেন না। তারা বধূকে একজন বন্ধুরূপে সর্বদা চান। তাকে সমানভাবে আপনার সুখ-দুঃখে, আপনার জীবনের নিগূঢ় সত্যে, অন্তরের সমস্ত বেদনা, আশা-আকাঙ্ক্ষা হাসি কান্না আলাপ-রহস্য সমস্ত অনুভূতিতে সর্বদা পেতে চান–তাকে রাত্রিকালে শুধু কামের সামগ্রীরূপে পেতে চান না–যুবক চিত্তের নারী সম্বন্ধে এই অনুভূতি যুগের প্রভাব হলেও এ প্রভাব বড় সুন্দর। পুরুষ নারীকে যে এইভাবে পেতে চায়–এ পাওয়া সত্যিকারের পাওয়া। নারীকে এইভাবেই পেতে হবে। নারী এইভাবে স্বামীর জীবনে নিজেকে ধ্বনিত করে। তুলবে, নইলে তার জীবন বৃথা। দু’জনার মধ্যে আকাশের মতো উঁচু ভেদ রয়েছে, শুধু কাম তাদের মিলনের ভিত্তি-এটি ভারী দোষের ধারণা। জাগ্রত মানুষের আত্মা নারীকে কখনও পশু ভাবে পেয়ে তৃপ্ত হতে পারে না। অথচ পুরানো লোকগুলি যারা যুবকদের শ্রদ্ধার পাত্র, তারা নারীকে এইভাবে পাওয়ার ঘোর বিরোধী। নারী সম্বন্ধে তাদের ধারণা খুব খারাপ। তারা পত্নীর সঙ্গে কথা বলতে দেখলে হাসতে দেখলে ভারী বিরক্ত হন–বেহায়া নির্লজ্জ শয়তান বলে গালি দেন। মেয়ে মানুষের গান গাওয়া তো তারা বেশ্যার কীর্তি মনে করেন। ছেলেরা বলে থিয়েটারে মেয়েদের গান শুনলে দোষ হয় না, গ্রামোফোনে নারীর গান ভাই বোন সবাই একসঙ্গে শোনে–সতী স্বামীগতপ্রাণা পত্নীর গান শুনলে কী ক্ষতি? ও আমরা শুনবই–আমাদের পরী সর্বপ্রকার পন্থায় আমাদের মন আকর্ষণ করবেন, আমদের চিত্তকে বেঁধে রাখবে, নইলে আমাদের মন অপবিত্র হয়, কুচিন্তায় পূর্ণ হয়। চরিত্রহীনা নারীর হাবভাব আমাদের কল্পনার বিষয় হয়ে পড়ে। ছেলেরা বিদ্রোহী হয়। গৃহে তাদের পিপাসা মেটে না–গ্রাম সমাজ ছেড়ে দূরে বিদেশে, যেখানে কেউ বলবার নাই, সেখানে পালায়। অনেকের সে সুবিধা নাই। কোনো কোনো সময় বধূরা বিদ্রোহিণী হন; ফলে ভারি একটা বিশ্রী অবস্থার সূচনা হয়।