১ম–আমরা সবাই দরিদ্র।
২য়–দরিদ্র তা ঠিক। কিন্তু দারিদ্রের বেদনা এ জাতির নাই। দুই পয়সার শাক খেয়ে সারারাত্রি শোকর করি, খোদা এ চান না। যেখানে অভাবের তীব্র অনুভূতি, সেইখানে মীমাংসার চেষ্টা। যে জাতির অভাবের বেদনা নাই–সে তা পূরণ করার জন্য ব্যস্ত হয় না। প্রভু ইচ্ছা করেন না, তার পুত্রেরা দুইখানি ফেলে দেওয়া হাড় খেয়ে লেজ দুলায়! জাতির পক্ষে কী লজ্জার কথা!
১ম বন্ধু–ঠিক কথা।
২য়–সমস্ত বিলাসিতা বর্জন করতে হবে। নিজে চাকর হও, নিজে রান্না কর। অনাবশ্যক বিলাদ্রব্য ত্যাগ কর-মজুর হও, তথাপি ভালো খাও, ভালো থাক।
১ম–বিলাসিতার খরচ কমিয়ে গাভী, মুরগী পেলে পুকুর-খাদকে মাছ দিয়ে ভরে খাবার বন্দোবস্তটা করা গেল; ভালো থাকি কী করে? খড়ের ঘরে নিজে সঁতসেঁতে মেঝের উপর শুয়ে ম্যালেরিয়ায় মরি, এর উপায় কী?
২য়–প্রত্যেক ভদ্রলোক, তুমি যেমন বল্লে একটু চেষ্টা করে খাবার সুবন্দোবস্ত করতে পারে–কিন্তু কয়জন তা করে? কে গাভীর যত্ন করে? কে মুরগীর চাষ করে? দেশে পুকুর আছে ঢের, কিন্তু কয়জন মাছের চাষ করতে আগ্রহী হন? ১০ পয়সার চিংড়ি এবং এক পয়সার সজিনার ডাটায় যখন আমাদের খাওয়া হয়, তখন আর অত চেষ্টা-চরিত্র করবার কী দরকার?–এই হচ্ছে আমাদের মানসিকতা। বলেছি–অভাব বেদনার অনুভূতি আমাদের নাই–অল্পেই আমরা কুকুরের মতো তুষ্ট হয়ে যাই–আমাদের মঙ্গল কোথা থেকে হবে? আমরা চিরদিন দাস হয়ে তো থাকবই। হ্যাঁ, তুমি জিজ্ঞাসা করছিলে ভালো। থাকি কী করে?
১ম–তাই জিজ্ঞাসা করছি?
২য়–যাদের ক্ষমতা আছে, তারাও ভালো ঘর এবং আলোবাতাসের ব্যবস্থা করে না। স্যাঁতসেঁতে ঘর এবং আলোহীন বায়ুহীন অন্ধকার ঘরে তাদের বাস করতে কোনো আপত্তি নেই।
১ম–বাসের জন্যে কীরূপ ঘর ভালো?
২য়–সকলের সাধ্যমত চেষ্টা করা কর্তব্য, বাসের জন্য পাকা ইটের ঘর তৈরি করা। এতে এমন কি টাকা লাগে?-অথচ এতে কত সুবিধা! খড়ের ও টিনের ঘরেই বেশি খরচ ক্ষতি; স্বাস্থ্য নষ্ট হয়।সর্প ও চোর-দস্যুর ভয়ও বিলক্ষণ আছে। লোকের ধারণা ইটের ঘরে খরচ বেশি–কিন্তু সে ধারণা একেবারে ভুল। অমিতব্যয়ী মানুষ অন্যায় বেহিসেবী এবং পান-তামাকের খরচে যে টাকা ব্যয় করে-তা একসঙ্গে করলে সংসারের শ্রেষ্ঠ দরকারি জিনিস, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন একটু বাসস্থান তৈরি হয়। প্রত্যেক বুদ্ধিমান ব্যক্তির কর্তব্য পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন একটু বাসস্থান প্রস্তুত করা-ভিক্ষুকেরও কর্তব্য ভিক্ষা করে স্থায়ী স্বাস্থ্যকর বাসস্থান নির্মাণ করা। নোংরা, অপরিষ্কার, অপবিত্র, সাপ-পোকার সঙ্গে বন্ধ ঘরে বাস করার অর্থ-এই সোনার মানব জীবনটাকে পশুর জীবনের মতো অবহেলা করা।
১ম–এইবারে যা বলবো, তা খোকার মার কাছ থেকে গোপন রেখো, নইলে আর আমায় বাড়িতে ঢুকতে দেবেন না।
প্রথম বন্ধু হাসিয়া বলিলেন–আমি বলবো, তোমার একটা সতীন আছেন, তিনি ঈর্ষা করে আমার মন বিষ করে দিচ্ছেন, তোমাকে আর ভালোবাসতে ইচ্ছা হয় না। দ্বিতীয় বন্ধু হাসিয়া উত্তর দিলেন–না, না, তা বলো না, তা হলে আমার দুর্গতির সীমা থাকবে না।
একটু থামিয়া বলিলেন-বন্ধু, ক্ষুধা ব্যতীত যেমন খাওয়া দাওয়া নিষেধ তীব্র ইচ্ছা ছাড়া কখনও পত্নীকে চাবে না। তাতে স্বাস্থ্যের বিলক্ষণ ক্ষতি হয়। পরীর সঙ্গে একই বিছানায় শোয়া নিষেধ। স্বামী-স্ত্রী উভয়েরই স্বতন্ত্র শয্যা থাকা চাই। যদি পাশাপাশি দুইটি প্রকোষ্ঠ হয়, তবে তাই খুব ভালো। স্বতন্ত্র প্রকোষ্ঠে নিজের নিজের মতো থাকবার, যাবার আসবার জন্যে মাঝের দেয়ালে একটা দরজা থাকবে। দরজার আবরণ থাকা চাই, অনবরত এক জনের উপর আর একজনের দৃষ্টি না পড়া চাই। প্রত্যেক মানুষের স্বভাবে একটা স্বাতন্ত্র এবং বিশিষ্টতা আছে–সেটাকে বজায় রেখেই স্বামী-স্ত্রীতে বাস করবে।
স্বামী-স্ত্রীর পক্ষে একই বিছানায় শোয়া ঠিক নয়–এতে স্বাস্থ্যের ক্ষতি হয়, দেখতে অশোভন এবং সুরুচির পথে বিঘ্নজনক। এক ঘরে অর্থাৎ একই প্রকোষ্ঠে থাকাও ঠিক নয়–অধিক স্পর্শে শরীরের ক্ষতি হয়, পরস্পরের প্রতি অশ্রদ্ধা হয়। ফলে মনোমালিন্য হওয়ার বিলক্ষণ সম্ভাবনা।
১ম–স্বামী-স্ত্রীতে এক ঘরে থাকা কি রকম কথা?
২য়–খড়ের ঘর হলে এক ঘরেই থাকতে হবে। তাছাড়া আর উপায় নাই। আমি বলছি একই প্রকোষ্ঠে অর্থাৎ এক কামরায় না থাকবার কথা। পাশাপাশি দুইটি কামড়ায় স্বামী-স্ত্রী দু’জনে বাস করবে। প্রত্যেকের জিনিসপত্র, বই-পুস্তক, বসবার আসন নিজের মতো থাকবে।
স্বামী-স্ত্রীর ঘরে অন্য কোনো লোকও থাকবে না। অনুমতি ছাড়া কেউ ঘরে প্রবেশ করবে না–ছেলেরাও না-৪ বৎসর হলেই ছেলেদের জন্য স্বতন্ত্র থাকবার ব্যবস্থা হবে। কখনও নিজের ঘরে রাখবে না। এতে ছেলেরা বাল্যকাল হতেই আত্মনির্ভরশীল হবে। মায়ের আঁচল ধরে পেছনে পেছনে থাকবার স্বভাব ছেলেদের দিনদিনই থাকে। এটা বড়ই দোষের। একটু সেয়ানা হলেই ছেলেদেরকে আত্মনির্ভরশীল হবার সুযোগ করে দাও। সেটা কোনো নিষ্ঠুরতা নয়। নিতান্ত শিশুকে মা নিজের ঘরে রাখবে। কিন্তু নিজের কাছে শোয়াবে না একটা রোলিং ঘেরা ছোট চৌকিতে স্বতন্ত্র করে শুইয়ে রাখবে; নিজের কাছে কখনও শোয়বে না–এতে শিশুর স্বাস্থ্যনাশে এবং মায়ের বিরক্তি ও স্বাস্থ্যনাশ হয়।