.
বিরোধ
পত্নীকে আনবার কয়েক দিন পর হইতেই স্বামী-স্ত্রীতে বিরোধ বাধিয়া উঠিল। বেলা পর্যন্ত থাকা, সকল কাজেই অবাধ্যতা, নিজের ইচ্ছামত চলা, সর্বদা রাগে কথা বলা–প্রভৃতি স্বভাবে ১ম বন্ধু মনে মনে দুঃখিত হইলেও, বন্ধুর উপদেশে তাহা মোটেই গ্রাহ্য করিলেন না। শিক্ষার অভাবই যে ইহার একমাত্র কারণ, তাহা তাহার বুঝিতে বাকি রহিল না। তিনি প্রাণপণে পত্নীকে শিক্ষা দিতে আরম্ভ করিলেন। প্রথম কয়েক দিনের অক্লান্ত চেষ্টায় প্রথম ভাগ ও দ্বিতীয় ভাগখানা শেষ হইল বটে, কিন্তু এখন দুই-একদিন পরই পড়িবার সময় হইলে ছেলেটি কাঁদিয়া ওঠে, না হয় পত্নীর মাথা ধরে!
পড়ার সুবিধা হইবে ভাবিয়া রাত্রি আটটার সময় দুই বন্ধু বাসায় ঢুকিয়া নিজেরাই রান্নার বন্দোবস্ত করেন।
দুই বন্ধুর এই আশ্চর্য কাণ্ড দেখিয়া থোকার মা মনে মনে হাসিত। এমনটি যে সে কোনো দিন দেখে নাই, শোনে নাই। স্বামীটাকে একটা মাথা পাগল, বন্ধুটাকেও অন্তত ততটা না ভাবিয়া খোকার মা বিছানার উপর আরামে ছেলেটাকে বুকের মধ্যে লইয়া থাকিবেন। পড়াশুনা খুব অল্পই হইত। নিতান্ত অনিচ্ছায় দুই-একবার পুস্তকের দিকে চোখ দিয়া অক্ষরগুলি দেখিত। ওসব তাহার মোটেই ভালো লাগে না। চিরকাল বাল্যকাল হইতে যে মেয়েদের ছেলেপেলে, রান্নাবান্না লইয়া নিতান্ত হালকাভাবে গল্প করিতে শুনিয়াছে, নিজেই তাহা করিয়াছে এবং তাহাতে তাহার অপরিসীম আনন্দ বোধ হইয়াছে। স্বামীকে সে কি মনে করে-কাপড়-চোপড়ের মতো একটা আবশ্যক দ্রব্য মাত্র, তাহার সংস্পর্শে একটা অপরিসীম আনন্দ অনুভূতির কল্পনাও সে করিতে পারে না স্বামীর সহিত সে কথা বলিতে চায় না–নূতন ঝিটির কাছে তাহার কোনো সঙ্কোচ নাই, সহজভাবে আনন্দে সারাদিন ধরিয়া গল্প করে, তাহাতে তাহার কিছুমাত্র কষ্ট হয় না–লজ্জাও হয় না।
স্বামী তাহাকে সমস্ত প্রাণ দিয়া ভালবাসিতে চায়। তাহার সহজ আলাপ, প্রেমহাস্য প্রতিনিয়ত কী একটা নিদারুণ অশোভন অসহজভাবে বিঘ্ন পায়। ব্যাপারটি স্বামীর কাছে নিতান্তই অস্বাভাবিক ঠেকে। মাঝে মাঝে দুঃখের আঘাত তাহার বুকের ভিতর জ্বলন্ত লৌহ-শলাকার মতো জ্বালা দিয়া যায়, কিন্তু পরক্ষণেই সে মনকে সান্ত্বনা দিয়া ভাবে, গ্রামে থাকার দরুন পত্নী স্বামীর সহিত কীরূপ উঠিতে বসিতে হয়, তাহা জানে না। কিছুদিন তালিম পাইলেই দুরস্ত হইয়া যাইবে। সে আনন্দে-উৎসাহে পরীকে জড়াইয়া ধরে মুখে। আদরের চুম্বন মুদ্রিত করিতে যায়। পরী বিরক্তিতে মুখ টান দেয় আহা ছাড় বলিয়া সরিয়া যায়। স্বামী প্রেমের আবেগে তাহা গ্রাহ্য করেন না।
এইভাবে ছয়মাস কাটিয়া গেল। অনেক কষ্ট করিয়া চারুশিক্ষার খানিকটা পড়া হইল। ইংরেজি ফার্স্ট বুকের অর্ধেকটা শেষ হইল, কিন্তু বহু কষ্ট করিয়াও শতকিয়া মুখস্ত হইল না
স্বামী ভাবিলেন–প্রথম প্রথম এরূপ হইয়াই থাকে। কুচ পরোয়া নাই।
.
স্বামী ও স্ত্রী
২য় বন্ধু কহিলেন-বন্ধু, কখনও দুঃখের কথা বলো না, নিরাশার কথা বলো না। যে ভুল হয়েছে, তবে আলোচনা করে শিরে করাঘাত করো না-এ সব মূর্খতা ছাড়া আর কিছু না। ভাঙ্গা তরীর উপর দাঁড়িয়ে হাসতে হবে, বেলাভূমির দিকে তাকিয়ে তরীকে ঠেলতে হবে। ডোবে ডুবুক, তবুও আনন্দ কর, হাস্য কর, সম্মুখে চল–হায় হায় করো না। দুঃখ, বিপদ, মৃত্যুর মাঝে পড়ো না–কখনও দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলো না, উহা পাপী মনুষ্যের কাজ। কখনও অভিযোগ করো না, কখনও অসন্তোষ প্রকাশ করেন না।
১ম–বন্ধু জীবনে তাই করবো।
২য়–কতকগুলি পরিবার আছে, যেখানে সবাই অনবরত হায় হায় করতে থাকে। দুঃখ না থাকলেও দুঃখ টেনে এনে গৃহকে অশান্তিপূর্ণ করে তোলে। এগুলি নিতান্তাই বোকামি। তাদের নিজের বুকে বিষ-গৃহের আলো-বাতাসকে বিষিয়ে তোলে, যারা তাদের স্পর্শে আসে তাদের জীবনকে পর্যন্ত তারা আনন্দহীন এবং তিক্ত করে তোলে।
১ম–বাস্তবিক এরা অভিশপ্ত, এদের মুখ দেখলে অযাত্রা।
২য়–যা বলেছ, তাই ঠিক। নারীদের পক্ষে এরূপ স্বভাব একেবারে অমার্জনীয় অপরাধ। নারীর জন্য দুঃখ, নিরানন্দ, নিরাশা, দীর্ঘনিঃশ্বাস, আক্ষেপ একেবারে হারাম নারী বৈশাখের ঝড়ের মতো আনন্দের প্রবাহ হবে–তার সামনে যে থাকে, তাকে একেবারে আনন্দের বারিধারা। কল্যাণ ঘোতে ডুবিয়ে নিয়ে যাবে। নারীর মুখে একমাত্র স্বামীর মৃত্যুতেই দুঃখ দেখা দেবে, আর কোনো অবস্থাতেই না। আলো যেমন অন্ধকারের শত্রু, নারী তেমনি দুঃখের বিপরীত অবস্থা-কোনো অবস্থাতেই সে দলিতা হবে না, কোনো অবস্থাতেই ক্রুদ্ধ। হবে না, দুঃখে-বিষাদে, দৈন্য-সম্পদে সর্বত্রই সে আলো, রস উৎস, শক্তি ও আশা।
১ম–বড় সুন্দর কথা।
২য়–দাম্পত্য জীবনে একটা বিষয় লক্ষ্য রাখতে হবে।
১ম–কী বিষয়?
২য়–সেটি হচ্ছে স্বাস্থ্য।
১ম–কী রকম?
২য়–বলছি। আমি অবিবাহিত মানুষ। লোকে মনে করবে আমি অনর্থক মোড়লী করছি, কিন্তু ঠিক তা নয়। আমি যা বলছি, তা সত্য।
১ম–আমি তা মনে করবো না।
২য়–মানুষের শত্রুই হচ্ছে জীবন। মূর্খেরা অপরিমিত শুক্র ব্যয় করে। কিন্তু খায় ছাই-ভস্ম। সকল মানুষকে রাতারাতি ব্রহ্মচারী হবার উপদেশ আমি দেই না, কিন্তু একপাল বিবাহিত সন্ন্যাসী হবার উপদেশও আমি দিই না। কথা কি–বিবাহিতাকে প্রচুর পুষ্টিকর খাদ্য আহার করতে হবেই শাক-কচু খেয়ে সংসার করলে অকালে বিবিধ ব্যাধি-পীড়িত হয়ে মারা যেতে হবে। দুঃখের বিষয় আমাদের কারো স্বাস্থ্যের প্রতি মোটেই দৃষ্টি নাই। লোকগুলি যে কত ভুল করে, তা ভাবলে আশ্চর্য হয়ে যাই। শরীর তো আর লোহা নয়–একে অনবরত পুষ্টির খাদ্য যোগাতে হবে নইলে মরণ, অকাল বার্ধক্য, প্রাণঘাতী ব্যাধি অপরিহার্য। ডিম, মুরগী, রোহিৎ মৎস্য ঘৃত, দুগ্ধ এসব প্রয়োজন। কেউ হয়তো বলবেন, দরিদ্রেরা এসব জোটাবে কী করে? সেটা হচ্ছে, স্বতন্ত্র প্রশ্ন। শরীর রক্ষা না করলে শরীর ভেঙে পড়বে; স্বাস্থ্য-বিজ্ঞানের এই সত্য দরিদ্রকে খাতির করে চলবে না। অনেক সময় আমরা স্বাস্থ্যরক্ষার গুরুত্ব অনুভব করি নে, ইচ্ছে করে কৃপণতা করে অপুষ্টিকর খাদ্য খাই, বিলাসিতা করে পয়সা উড়িয়ে দেই-না খেয়ে আত্মহত্যা করি। শরীরটা মাংসের ইঞ্জিন বই তো নয়–কয়লা ও জল অভাবে ট্রেনখানি টেনে নেওয়া দূরের কথা, নিজেই নিজের ভারে অচল হয়ে পড়তে হবে। ভালো পুষ্টিকর আহার চাই, বাসের জন্য ভালো ঘর চাই, আলো চাই, বাতাস চাই, তবেই জীবনের কল্যাণ ও প্রসন্নতা লাভ হবে। দুঃখ জিনিসটা পাপ, মৃত্যু এবং অন্ধকার। ওর বিরুদ্ধে লড়াই করতে হবে। আমরা চাই স্বাস্থ্য, আলো, জীবন, আনন্দ ও রস।