মুখ না তুলে বুড়ে বলে,–হেই কথা আপনার ব্যাক্কই জানেন।
কে একজন গল উঠিয়ে বলে, কথা ঠিক কইরা কও মিঞা।
বুড়ো ওদিকে একবার ফিরেও তাকায় না।
খালেক ব্যাপারী আবার প্রশ্ন করে,–এহন কও, হেই কথা তুমি ঢাকপার চাও ক্যান?
কথাটা যেন বুঝলে না ঠিকমতো–এমন একটা ভঙ্গি করে বুড়ো তাকায় সকলের পানে। তারপর বলে, -এইটা কি কওনের কথা? বুড়ীমাগী ঝুটমুট একখান কথা কয়–তা বইলা আমি কী পাড়ায় ঢোল-সোহরাত দিমু?
ওর কথা বলার ভঙ্গি ব্যাপারীর মোটেই ভালো লাগে না। মজিদ নীরব হয়ে থাকে, কিন্তু উত্তর শুনে তারও চোখ জ্বলে ধিকিধিকি।
লোকটির উত্তরে কিন্তু ভুল নেই। তাই প্ৰত্যুত্তরের জন্য সহসা কিছু না পেয়ে খালেক ব্যাপারী ধমকে উঠে বলে,–কথা ঠিক কইরা কইবার পারো না?
জমায়েতের মধ্যে কয়েকটা গলা আবার চেচিয়ে ওঠে,–কথা ঠিক কইরা কও মিঞা, কথা ঠিক কইরা কও।
বৈঠক শান্ত হলে খালেক ব্যাপারী আবার বলে,—তুমি তোমার মাইয়ারে ঠ্যাঙাইছ ক্যান?
–আমার মাইয়া আমি ঠ্যাঙাইছিা!
–লম্বামুখ খাড়া করে নির্বিকারভাবে উত্তর দেয় তাহেরের বাপ, যেন ভয়-ডর নেই। অবশ্য হাতের দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যায়, আঙুলগুলো কাঁপছে। ভেতরে তার ক্ৰোধের আগুন জ্বলছে—বাইরে যতই ঠাণ্ডা থাকুক না কেন?
ব্যাপারী কী একটা বলতে যাচ্ছিল, এবার হাত নেড়ে মজিদ তাকে থামিয়ে নিজে বলবার জন্য তৈরী হয়। ব্যাপারটা আগে গোড়া থেকে ব্যাপারীকে বুঝিয়ে বলেছিল সে, এবং ভেবেছিল তার পক্ষে থেকে খালেক ব্যাপারীই কাজটা ঠিকমতে চালিয়ে নেবে কিন্তু তার প্রশ্নগুলো তেমন জুতসই হচ্ছে না। বলছে আর যেন ঠাস করে মুখের ওপর চড় খাচ্ছে।
মজিদ গম্ভীর গলায় বলে,—ভাই সকল! বলে থেমে তাকায় সবার পানে। পিঠ সোজা করে বসেছে, কোলের ওপর হাত। আসল কথা শুরু করার আগে সে এমন একটা আবহাওয়া সৃষ্টি করে যে, মনে হয় ছুবাঙ্ক ফাতেহা পড়ে তার বক্তব্য শুরু করবে। কিন্তু আরেক বার ভাই সকল বলে সে কথা শুরু করে। বলে, খোদাতালার কুদরত মানুষের বুঝবার ক্ষমতা নাই; দোষগুণে তৈয়ার মানুষ। মানুষের মধ্যে তাই শয়তান আছে, ফেরেস্তাও আছে। তাদের মধ্যে গুণাগার আছে, নেকবন্দ আছে। কুৎসা রটনোটা বড় গৰ্হিত কাজ। কিন্তু যারা শয়তানের চতুরী বুঝতে পারে না, যারা তাদের লোভনীয় ফাঁদে ধরা দেয় এবং খোদার ভয়কে দিল থেকে মুছে ফেলে।–তারা এইসব গৰ্হিত কাজে নিজেদের লিপ্ত করে। মানুষের রসনা বড় ভয়ানক বস্তু, সে-রসন বিষাক্ত সাপের রসনার চেয়েও ভয়ঙ্কর হতে পারে। প্ৰক্ষিপ্ত সে-রসন তার বিযে পরিবারকে-পরিবার ধ্বংস করে দিতে পারে, নিমেষে আগুন ধরিয়ে দিতে পারে সমস্ত পৃথিবীতে।
ঋজু ভঙ্গিতে বসে গম্ভীর কণ্ঠে ঢালাসুরে মজিদ বলে চলে। কথায় তার মধু। স্তব্ধ ঘরে তার কণ্ঠে একটা সুর তোলে, যে সুরে মোহিত হয়ে পড়ে শ্রোতারা।
একবার মজিদ থামে। শান্ত চোখ, কারো দিকে তাকায় না। সে। দাড়িতে আলগোছে হাত বুলিয়ে তারপর আবার শুরু করে,
—পৃথিবীর মধ্যে যিনি সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি তাঁর ও তাঁর পরিবারের বিরুদ্ধেও মানুষের সে-রসন প্ৰক্ষিপ্ত হয়েছে। পঞ্চম হিজরীতে প্ৰিয় পয়-গম্বরের নিকট বাণী এল; মুস্তালিখ*-এর বিরুদ্ধে লড়াই করে প্রত্যাবর্তন করবার সময় তাঁর ছোট বিবি আয়েশা কি করে দলচু্যত হয়ে পড়েন। তারপর তিনি পথ হারিয়ে ফেলেন। এক নওজোয়ান সিপাই তাকে খুঁজে পায়। পেয়ে তাকে সসম্মানে নিজেরই উটে বসিয়ে আর নিজে পায়দল হেঁট প্রিয় পয়গম্বরের কাছে পৌঁছে দিয়ে যায়। যাদের অন্তরে শয়তানের একচ্ছত্ৰ প্ৰভুত্ব–যারা তারই চক্রান্তে খোদার রোশনাই থেকে নিজের হৃদয়কে বঞ্চিত করে রাখে, তাদেরই বিষাক্ত রসনা সেদিন কর্মতৎপর হয়ে উঠল। হজরতের এত পেয়ারা বিবির নামেও তারা কুৎসা রটাতে লাগল। বড় ব্যথা পেলেন পয়গম্বর। খোদার কাছে কেঁদে বললেন, এরা খোদা পরওয়ার-দেগার, নির্দোষ আমার বিবি কেন এত লাঞ্ছনা ভোগ করবে, কেন এ অকথ্য বদনাম সহ্য করবে? উত্তরে খোদাতালা মানব জাতিকে বললেন—
থেমে বিসমিল্লাহ পড়ে মজিদ ছুরায়ে আন-নূর থেকে খানিকটা কেরাত করে শোনায়। তার গম্ভীর কণ্ঠ হঠাৎ মিহি সুরে ভেঙে পড়ে। স্তব্ধ ঘরে বিচিত্র সুরঝঙ্কার ওঠে। শুনে জমায়েতের অনেকের চোখ ছলছল করে ওঠে।
হঠাৎ এক সময়ে মজিদ কেরাত বন্ধ করে, করে সরাসরি তাহেরের বাপের পানে তাকায়, যে-লোকটা এতক্ষণ একটা বিদ্রোহী ভাব নিয়ে কঠিন হয়ে ছিল, তারও চোখ এখন নরম। বসে থাকার মধ্যে উদ্ধত ভাবাটাও যেন নেই। চোখাচোখি হতে সে চোখ নামায়।
কয়েক মুহুর্ত তার পানে তাকিয়ে থেকে গল উঠিয়ে মজিদ বলে যে, খোদাতালার ভেদ তীরই সৃষ্ট বান্দার পক্ষে বোঝা সম্ভব নয়। মানুষের মধ্যে তিনি বিষময় রসনা দিয়েছেন, মধুময় রসনাও দিয়েছেন। উদ্ধত করেও সৃষ্টি করেছেন তাকে, মাটির মতো করেও সৃষ্টি করেছেন। সে যাই হোক, মানুষের কাছে আপনি সংসার, আপনি বালবাচ্চ দুনিয়ার সব চাইতে প্ৰিয়। তাদের সুখ-শান্তির জন্যে সে অক্লান্ত পরিশ্রম করে, জীবনের সঙ্গে লড়াই করে। আপনি সংসারের ভালোই ছাড়া অন্য কিছু ভাবতে পারে না সে। কিন্তু যে-মেয়েলোক আপনি সংসার আপনি হাতে ভাঙতে চায় এবং আপনি সস্তানের জন্ম সম্পর্কে কুৎসা রটনা করে, সে নিজের বিরুদ্ধে কাজ করে, খোদার বিরুদ্ধে আঙুল ওঠায়—তার গুণাহু বড় মস্ত গুণাহ, তার শাস্তি বড় কঠিন শাস্তি।