আবার কতক্ষণ নীরব থেকে মজিদ বলে,
–বিবিরে কইয়া দিও, অমন কথা যদি আর কোনোদিন কয় তাইলে মছিবৎ হইব।
মাথা নেড়ে বুড়ে চলে যাবার জন্যে পা বাড়ায়। কয়েক পা গিয়ে থামে, থেমে মাথা চুলকে বলে,—হুজুর, কোথিকা হুনলেন বেটির কথা?
–তা দিয়া তোমার দরকার কী? কিন্তু এই কথা জাইনো কোনো কথা আমার অজানা থাকে না।
সারাপথ ভাবে বুড়ে। কে বলল কথাটা? বাড়ির গায়ে আর কোনো বাড়ি নেই যে, কেউ আড়ি পেতে শুনবে।
এককালে বুড়ো বুদ্ধিমান লোকই ছিল। সারাজীবন দুষ্ট প্রকৃতির বৈমাত্ৰেয় এক ভাই-এর সাথে জায়গাজমি সম্পত্তি নিয়ে মারামারি মামলা-মকদ্দমা করে আজ সব দিক দিয়ে সে নিঃস্ব। জায়গাজমির মধ্যে আছে একমুঠো পরিমাণ জমি, যা দিয়ে একজনের পেট ভরে না। আর এদিকে পেয়েছে খিটখিটে মেজাজ। সবাইকে দু’চোখের বিষ মনে হয়। বুড়ীটার হয়তো তার ছোয়াচ লেগেই আমন হয়েছে। নইলে বহুদিন আগে যৌবনে কেমন হাসিখুশি ছটফট মেয়ে ছিল সে। স্থির থাকত না এক মুহুর্ত, নাচত কেবল নাচত, আর খই-এর মতো কথা ফুটত মুখ দিয়ে। আজ তার সুন্দর দেহমান পচে গিয়ে এই হাল হয়েছে।
বুড়ী যে ছেলেদের জন্ম নিয়ে কথাটা বলতে শুরু করেছে তা বেশীদিন নয়। সাধারণ গালগালি দিয়ে আর স্বাদ হয় না; তাই এমন এক কথা বের করেছে যা বুড়োর আত্মায় গিয়ে খচ করে লাগে। কথাটা মিথ্যা জেনেও প্ৰচণ্ড ক্ৰোধে জ্বলে ওঠে। অন্তরটা।
বুড়ে ভাবে, ছেলেরা বলতে পারে না কথাটা। সে-বিষয়ে নিঃসন্দেহ। তবে কি হাসুনির মা বলেছে? তার তো ও বাড়িতে যাতায়াত আছে।
একটা বিষয়ে কিন্তু গোলমাল নেই তার মনে। অন্তরের শক্তিতে মজিদ ব্যাপারটা জানতে পেরেছে সে কথা সে বিশ্বাস করে না।
যত ভাবে কথাটা তত জ্বলে ওঠে। বুড়ে। যে বলেছে সেকি কথাটার গুরুত্ব বোঝে না? কথাটা কী বাইরে ছড়াবার মতো? এর বিহিত ঘরেই হয়, বাইরে হয় না।–তা যতই আলেম-খোদাবন্দ মানুষ তার বিহিত করতে আসুক না কেন। তাছাড়া, কথাটায় যে বিন্দুমাত্র সত্য নেই কে বলতে পারে? এককালে বুড়ী উড়নি মেয়ে ছিল, তার হাসি আর নাচন দেখে পাগল হতো কত লোক। বৈমাত্রেয় ভাইটির সঙ্গে ঝগড়া-বিবাদের শুরুতে একবার একটা লোক ঘরে ঢোকার জনরব উঠেছিল। একদিন তার অনুপস্থিতিতে সে কাণ্ডটি নাকি ঘটেছিল। কিন্তু ঘরের বউ অনেক ঠ্যাঙনি খেয়েও কথাটা যখন স্বীকার করেনি তখন সে বিশ্বাস করে নিয়েছিল যে, তা দুষ্ট প্রকৃতির বৈমাত্রেয় ভাইটির সৃষ্টি ছাড়া কিছু নয়।
অন্দরে ঢুকেই সামনে দেখলে হাসুনির মাকে। দেখেই চড়াচড় করে মেজাজ গরম হয়ে উঠে, ঘূর্ণি খেয়ে চোখ অন্ধকার হয়ে যায়। বকের মতো গলা বাড়িয়ে ছুটে গিয়ে তাকে ধরে এক আছাড়ে মাটিতে ফেলে দেয়। তারপর শুরু হয় প্রহার। প্ৰহার করতে করতে বুড়ার মুখে ফেনা উঠে যায়। আর বলে কেবল একটি কথা।–ওরে ভাতারা-খাইগা জারুণি, তোর বাপরে গিয়া কইলি ক্যামনে ওই কথা?
প্ৰাণের আশ মিটিয়ে বুড়ো তার মেয়েকে মারে। ছেলেরা তখন ঘরে ছিল না বলে তাকে রক্ষা করবার কেউ ছিল না। বুড়ী অবশ্য আঁধারে পা ছড়িয়ে তীক্ষ্ম-কণ্ঠে বিলাপ জুড়ে দেয়, কিন্তু বিলাপ শুনে দমবার পাত্ৰ বুড়ে নয়।
সে-দিন দুপুরে মুখে আঘাতের চিহ্ন ও সারা দেহে ব্যথা নিয়ে চুপিচুপি ঘর থেকে বেরিয়ে হাসুনির মা সোজা চলে গেল মজিদের বাড়ি। মজিদ। তখন জিরুচ্ছে আর সে-ঘরেই নীচে পাটিতে বসে রহীমা কঁথায় শেষ কটা ফোঁড় দিচ্ছে।
হাসুনির মা মজিদের সামনে আসে না। কিন্তু আজ সটান ঘরে ঢুকে তার সামনেই রহীমার পাশে বসে মরাকান্না জুড়ে দিলো। প্ৰথমে কিছু বোঝা গেলো না। কথা স্পষ্টতর হয়ে এলে এইটুকু বোঝা গেলো যে, সে রহীমাকে বলছে; ওনারে কন, আমার মওতের জন্য যানি দোয়া করে।
মজিদ হুঁকা টানে আর চেয়ে চেয়ে দেখে। ক্ৰন্দনরত মেয়ে তার ভালোই লাগে। কথায় কথায় ঠোঁট ফুলবে, লুটিয়ে পড়ে কঁদবেএমন একটা বউ-এর স্বপ্ন দেখত প্ৰথম যৌবনে। রহীমার না আছে অভিমান, না আছে চপলতা! অপরাধ, না করে থাকলেও মজিদ বলছে বলে যে-কোনো কথা নির্বিবাদে মেনে নেয়। অমন মানুষ ভালো লাগে না তার।
পরে সব কথা শুনে মজিদের মুখ হঠাৎ কঠিন হয়ে যায়। বুড়ো গিয়ে তার মেয়েকে মেরেছে। মেরেছে এই জন্য যে, সে এসে তাকে কথাটা বলে দিয়েছে।
অনেকক্ষণ গুম হয়ে থেকে মজিদ গম্ভীর কণ্ঠে রহীমাকে বলে,–অরে। যাইতে কও। আর কও আমি দেখুম নি।
একটু পরে রহীমা বলে,–ও যাইবার চায় না। ডরায়।
মজিদ আড়চোখে একবার তাকায় হাসুনির মায়ের দিকে। কান্না থামিয়ে মজিদের দিকে পিঠি দিয়ে বসে আছে, আর ঘোমটা-টানা মাথা নত করে নখ দিয়ে মাটি খুটিছে। ওধারে ফেরানো মুখটি দেখবার জন্যে। এক মুহুর্ত কৌতুহল বোধ করে মজিদ। তারপর তেমনি গভীর কণ্ঠে বলে–থাক তাইলে এইখানে।
০৩. অপরাহ্নে জমায়েত হয়
অপরাহ্নে জমায়েত হয়। এক বিচার করতে ভরসা হয় না যেন মজিদের। ঢেঙা বুড়ো লোকটা শয়তানের খাম্বা, অন্তরে তার কুটিলতা আর অবিশ্বাস।
খালেক ব্যাপারীও এসেছে। মাতববর না হলে শাস্তি বিধান হয় না, বিচার চলে না। রায় অবশ্য মজিদই দেয়, কিন্তু সেটা মাতকবরের মুখ দিয়ে বেরুলে ভালো দেখায়।
একটু তফাতে মাটিতে বসে চুপচাপ হয়ে আছে তাহেরের বাপ, মুখটি একদিকে সরানো।
খালেক ব্যাপারী বাজখাই গলায় প্রশ্ন করে,–তোমার বিবি কী বলে?