অনেক সময় অদ্ভুত আৰ্জি নিয়ে মেয়েলোকেরা আসে রহীমার কাছে। যেমন আসে ধান ভাননি হাসুনির মা। বহুদিন আগে নিরাকপড়া এক শ্রাবণের দুপুরে মাছ ধরতে মতিগঞ্জের সড়কের ওপর যারা প্ৰথম মজিদকে দেখেছিল, সেই তাহের আর কাদেরের বোন হাসুনির মা। সে এসে বলে,
-আমার এক আৰ্জি।
এমন এক ভঙ্গিতে বলে যে রহীমার হাসি পায়। কিন্তু মনে মনেই হাসে, গম্ভীর হয়ে থাকে বাইরে। হাসুনির মা বলে,
-আমার আর্জি–ওনারে কইবেন, আমার যেন মওত হয়।
এবার ঈষৎ হেসে রহীমা বলে,
–ক্যান গো বিটি?
-জ্বালা আর সইহ্য হয় না বুবু। আল্লায় যেন আমারে সত্বর দুনিয়া থিক। লইয়া যায়।
সকৌতুকে রহীমা প্রশ্ন করে,
—তোমার হাসুনির কী হইব তুমি মরলে?
সেদিকে তার ভাবনা নেই। আপনা থেকেই যেন উত্তর যোগায় মুখে।
—তুমি নিবা বুবু। তোমারই হাতে সোপর্দ কইরা আমি খালাস হমু।
রাহীমা হাসে। হাতে কাঁথার কাজ। হাসে আর মাথা নত করে কঁথা সেলাই কবে।
একদিন হাসুনির মা এসে বলে,
—আমার এক আর্জি বুবু।
–কও?
-ওনারে কইবেন–বুড়াবুড়ী দুইগারে যানি দুনিয়ার থান লইয়া যায় খোদাতালা।
কৃত্রিম বিস্ময়ে চোখ তুলে চেয়ে রহীমা প্রশ্ন করে,
-ওইটা আবার কেমন কথা হইল?
—হ, খাঁটি কথা কইলাম বুবু। দুইটার লাঠালাঠি চুলচুলি আর ভালো লাগে না।
বুড়ো বাপ তার ঢেঙা দীর্ঘ মানুষ; মা ছোটখাটো, কেঁকড়ানো। কিন্তু দু’জনের মুখে বিষ। ঝগড়া-ফ্যাসাদ লেগেই আছে। তবে এক একদিন এমন লাগা লাগে যে, খুনখুনি হবার জোগাড়। ঢেঙা লোকটি তেড়ে আসে বারবার, ঘুণধরা হাড় কড়কড় করে। বুড়ী ওদিকে নড়েচড়ে না। এক জায়গায় বসে থেকে মাথা ঝাপিয়ে ঝাপিয়ে রাজ্যের গালাগাল জুড়ে দেয়। গালাগাল দিয়ে বুড়োকে যখন বিন্দুমাত্র ঘায়েল করতে পারে না তখন শেষ অস্ত্ৰ হানে।
-ওরে মরার ব্যাটা, তুই কী ভাবছস? ভাবছস বুঝি পোলাগুলি তোর জন্মের? আল্লা সাক্ষী–হেগুলি তোর জন্মের না, তোর জন্মের না!
শুনে হাসুনির মায়ের কান লাল হয়ে ওঠে; আর আঁচলে মুখ লুকিয়ে হাসে।
তাহের-কাদের, আর কনিষ্ঠ ভাই রতন–তাদের বুদ্ধি-বিবেচনা থাকলেও তা আবার স্বার্থের ঘেরে ঢাকা। সামান্য হলেও বাপের জমি আছে, ঘর আছে, লাঙল-গরু আছে। তার দিনও ঘনিয়ে এসেছেআর বর্ষায় টেকে। কিনা সন্দেহ। তারা চুপ করে শোনে।
অন্ধ ক্ৰোধে কাঁপিতে কাঁপিতে বুড়া বাপ এগিয়ে আসে। ছেলেদের পানে চেয়ে বলে,
-হুনছস কথা, হুনছস?
ছেলেরা সমস্বরে বলে,–ঠ্যাঙা বেটিরে, ঠ্যাঙা।
সমর্থন পেয়ে বুড়ো চেলা নিয়ে দৌড়ে আসে। তাহের শেষে জমিজোতের মায়া ছেড়ে বাপের হাত ধরে ফেলে। কাদের বোঝায়,–থাক, কইবার দেও। খোদাই তার শাস্তি দিবো।
জন্মের কথা নিয়ে মায়ের উক্তি শুনে হাসুনির মায়ের কান লাল হয়ে ওঠে, কিন্তু পরে বুকে যন্ত্রণা হয়। তাই রহীমাকে এসে বলে কথাটা।
–হয় বুড়াবুড়ী দুইটাই মরুক–নয় ওনারে কন, এর একটা বিহিত করবার।
হঠাৎ সমবেদনায় রহীমার চোখ ছল ছল করে ওঠে। বলে,
—তুমি দুঃখ করিও না বিটি। আমি কমুনে।
মেয়েটাকে তার ভালোই লাগে। দুঃস্থা মেয়ে। স্বামী মারা যাবার পর থেকে বাপের বাড়িতে আছে। বাড়িতে তিন-তিনটে মর্দ ছেলে বসে বসে খায়। এক মুঠোর মতো যো-জমি, সে-জমিতে ওদের পেট ভরে না। তাই টানাটানি, আধ-পেটা খেয়ে দিন গুজরান। বসে বসে অন্ন ধ্বংস করতে লজ্জা লাগে হাসুনির মায়ের। সে তো এক নয়, তার হাসুনিও আছে। তাই বাড়িতে ধান ভানে। কিন্তু কিছু একটা মুখ ফুটে চাইতে আবার লজ্জায় মরে যায়।
রহীমা বলে,
-শ্বশুর বাড়িতে যাও না ক্যান?
—অরা মনুষ্যি না।
–নিকা করে না ক্যান?
কয়েক মুহুর্ত থেমে হাসুনির মা বলে, দিলে চায় না বুবু।
জীবনে তার আর সখ নেই। তবে গায়ের আর মানুষের রক্ত তারও দেহে বয় বলে মাঠ ভরে ধান ফললে অন্তরে তার রঙ ধরে। বতোর দিনে বাড়ি বাড়ি কাজ করে হাসুনির মায়ের ক্লান্তি নেই। মুখে বরঞ্চ চিকনাই-ই দেখা দেয়। এমনি কোনো দিনে তাহের খোশ মেজাজে
বলে,
-শরীলে রঙ ধরছে ক্যান, নিকা করবি নাকি?
বুড়ী আমের আঁটির মতো মুখটা বাড়িয়ে বলে,–খানকির বেটি নিকা করবো বলাই তো মানুষটারে খাইছে!
মানুষটা মানে তার মৃত স্বামী। তাহের কৌতুক বোধ করে। বলে, ক্যামনে খাইছস?
হাসুনির মায়ের অন্তর তখন খুশিতে টলমল। কথা গায়ে মাখে না। হেসে বলে,–গিলা খাইছি। মা-বুড়ী আছে সামনে, নইলে গিলে খাওয়ার ভঙ্গিটাও একবার দেখিয়ে দিত।
দূরে ধানক্ষেতে ঝড় ওঠে, বন্য আসে পথভোলা অন্ধ হওয়ায়, দিগন্ত থেকে গড়িয়ে গড়িয়ে আসে অফুরন্ত ঢেউ। ধানক্ষেতের তাজা রঙে হাসুনির মায়ের মনে পুলক জাগে। আপন মনকেই ঠাট্টা করে বারবার শুধায় : নিকা করবি মাগি, নিকা করবি?
কিন্তু কাকে করে? ওই বাড়ির মানুষকে পেলে করে কী? তেল চকচকে জোয়ান কালো ছেলে। গলা ছেড়ে যখন গান ধরে তখন ধানের ক্ষেতে যেন ঢেউ ওঠে।
পরদিন তাহেরের বুড়ো ব্যাপকে মজিদ ডেকে পাঠায়। এলে বলে,- তোমার বিবি কী কয়?
বুড়ো ইতস্তত করে, ঘাড় চুলকে এধার-ওধার চেয়ে আমতা-আমতা করে। মজিদ ধমকে ওঠে।
-কও না ক্যান?
ধমক খেয়ে ঢোক গিলে বুড়ে বলে,–তা হুজুর ঘরের কথা আপনারে ক্যামনে কই?
কতক্ষণ চুপ থেকে মজিদ ভারী গলায় বলে,–আমি জানি কী কয়। কিন্তু তুমি কেমন মদ, দাঁড়াইয়া দাঁড়াইয়া শোনো হেই কথা?
দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শোনে এ কথা ঠিক নয়। তখন রাগে সে চোখে অন্ধকার দেখে, চেলা কাঠ নিয়ে ছুটে যায় বুড়ীকে শেষ করবার জন্যে। এর মধ্যে একদিন হয়তো সে শেষই হয়ে যেত—যদি না ছেলেরা এসে বাধা দিত। কিন্তু সে কথাও বলতে পারে না মজিদের সামনে। কেবল আস্তে বলে,–বুড়ীর দেমাক খারাপ হইছে হুজুর। আপনে যদি দেয়া পানি দ্যান…