এত শ্রম এত কষ্ট, তবু ভাগ্যের ঠিকাঠিকানা নেই। চৈত্রের শেষ দিক বা বৈশাখের শুরু। ধান ওঠে-ওঠে, এমন সময়ে কোনো এক দুপুরে কালো মেঘের সাথে আসে ঝড়, আসে শিলাবৃষ্টি, হয়তো না বলে না কয়ে নিমেষেব মধ্যে ধ্বংস করে দিয়ে যায় মাঠ। কোচবিদ্ধ হয়ে নিহত ছমিরুদিনের রক্তাঙ্গুত দেহের পানে চেয়ে আবেদ-জাবেদের মনে দানবীয় উল্লাস হতে পারে, কিন্তু এখন তারা পাথর হয়ে যায়। যার একরাত্তি জমিও নেই, তারও চোখ ছলছল করে ওঠে। এবং হয়তো তখন খোদাকে স্মরণ করে, হয়তো করে না।
মাঠের প্রান্তে একাকী দাঁড়িয়ে মজিদ দাঁত খিলাল করে আর সে কথাই ভাবে। কাতারে কাতারে সারবন্দী হয়ে দ্বিতীয়ার চাঁদের মতো কাস্তে নিয়ে মজুররা যখন ধান কাটে আর বুক ফাটিয়ে গীত গায় তখনো মজিদ দূরে দাঁড়িয়ে দেখে আর ভাবে। গলার তামার খিলাল দিয়ে দাঁতের গহবর গুতোয় আর ভাবে। কিসের এত গান, এত আনন্দ? মজিদের চোখ ছোট হয়ে আসে। রহীমার শরীরে তো এদেরই রক্ত, আর তার মতোই এরা তাগড়া, গােটাগোট্টা ও প্রশস্ত। রহীমার চোখে ভয় দেখেছে মজিদ। এরা কি ভয় পাবে না? ওদের গান আকাশে ভাসে, ঝিলমিল করতে থাকা ধানের শীষে এদের আকৰ্ণ হাসির ঝলক লাগে। ওদের খোদার ভয় নেই। মজিদও চায়, তার গোলা ভরে উঠক ধানে। কিন্তু সে তো জমিকে ধন মনে করে না, আপন রক্তমাংসের সামিল খেয়াল করে না? শ্যেন দৃষ্টিতে অবশ্য চেয়ে চেয়ে দেখে ধানকাটা; কিন্তু তাদের মতো লোম-জাগানো পুলক লাগে না তার অন্তরে। হাসি তাদের প্রাণ, এ-কথা মজিদের ভালো লাগে না। তাদের গীত ও হাসিও ভালো লাগে না। ঝালরওয়ালা সালু কাপড়ে আবৃত মাজারটিকে তাদের হাসি আর গীত অবজ্ঞা করে যেন।
জমায়েতকে মজিদ বলে, খোদাই রিজিক দেনেওয়ালা।
শুনে সালু কাপড়ের ঢাকা রহস্যময়, চিরনীরব মাজারের পাশে তারা স্তব্ধ হয়ে যায়।
মজিদ বলে, মাঠভরা ধান দেখে যাদের মনে মাটির প্রতি পূজার ভাব জাগে তারা বুত-পূজারী। তারা গুণাগার।
জমায়েত মাথা হেঁট করে থাকে।
বতোর দিন ঘুরে আসে, আবার পেরিয়ে যায়। মজিদের জমিজোত বাড়ে, সঙ্গে সঙ্গে সম্মানও বাড়ে। গায়ের মাতব্বর ওর কথা ছাড়া কথা কয় না; সলাপরামর্শ, আদেশ-উপদেশ, নাছিহতের জন্যে তার কাছেই আসে, চিরনীরব সালু কাপড়ে আবৃত মাজারের মুখপাত্র হিসেবে তার কথা সাগ্রহে শোনে, খরা পড়লে তারই কাছে ছুটে আসে খতম পড়বার জন্যে। খোদা রিজিক দেনেওয়ালা এ-কথা তারা আজ বোঝে। মাঠের বুকে গান গেয়ে গজব কাটানো যায় না, বোঝে। মজিদও আত্মবিশ্বাস পায়।
মজিদ সাত ছেলের বাপ দুদু মিঞাকে প্রশ্ন করে,–কলমা জানো মিঞা?
ঘাড় গুজে আধাপাকা মাথা চুলকায় দুদু মিঞা। মুখে লজ্জার হাসি।
গর্জে উঠে মজিদ বলে,–হাসিও না মিঞা।
থতামত খেয়ে হাসি বন্ধ করে দুদু মিঞা।
সাত ছেলের এক ছেলে সঙ্গে এসেছিল। সে বাপের অবস্থা দেখে খিলখিল করে হাসে। বাপের মাথা নত করে থাকার ভঙ্গিটা যেন গাধার ভঙ্গির মতো হয়ে উঠেছে।
চোখ কিন্তু তার পিটপিট করে। বলে,—আমি গরীব মুরুক্ষু মানুষ।
খোদাকে হয়তো সে জানে। কিন্তু জ্বলন্ত পেটের মধ্যে সব কিছু যেন বাষ্প হয়ে মিলিয়ে যায়। ভেতরে গনগনে আগুন, সব উড়ে যায়, পুড়ে যায়। আজ লজ্জায় মাথা নত করে রাখে–গাধার মতো পিঠে ঘাড়ে সমান।
এবার খালেক ব্যাপারী ধমকে ওঠে,–কলমা জানস না ব্যাটা?
সে আর মাথা তোলে না। ছেলেটা হাসে।
খালেক ব্যাপারী একটি মক্তব্য দিয়েছে। এরই মধ্যে একপাল ছেলেমেয়ে জুটে গেছে। ভোরে যখন কলতান করে আমসিপারা পড়ে তখন কখনো মজিদের মনে স্মৃতি জাগে। শৈশবের স্মৃতি–যে-দেশ ছেড়ে এসেছে, যে-শস্যহীন দেশ তার জন্মস্থান–সেখানে একদা এক মক্তবে এই রকম করে সে আমসিপারা পড়ত।
অবশেষে মজিদ আদেশ দেয়।
—ব্যাপাবীর মক্তবে তুমি কলম শিখবা।
ঘাড় নেড়ে তখুনি রাজি হয়ে যায় লোকটি। শেষে মুখ তুলে বোকার মতো বলে,
-গরীব মানুষ, খাইবার পাই না।
লোকটির মাথায় যেন ছিটা। যত্রতত্র কাবণ্যে-অকারণে না খেতে পাওয়ার কথাটি শোনানো অভ্যাস তার। শুনিয়ে হয়তো মানুষের সমবেদন আকর্ষণ করার চেষ্টা করে। কিন্তু লোকে খেতে পায়, পায় না; এতে সমবেদনার কী আছে? প্রশ্ন থাকলে তো সমবেদন থাকবে। ও কী করে আমন গাধার মতো ঘাড়-পিঠ সমান করতে পারে সে-কথা। তো। কেউ জিজ্ঞেস করে না। দৃশ্যটি অবশ্য উপভোগ করে।
মজিদের পক্ষ থেকে খালেক ব্যাপারী ধমকে বলে,
—হইছে হইছে, ভাগ।
একদিন ধাড়িধাড়ি ছেলে কয়েকটি পাকড়াও করে মজিদ।
–কীরে ব্যাটা, খৎনা হইছে?
একটি ছেলে আরেকটিকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বলে,
–আর অয় নাই।
সে রেগে বলে–অরও অয় নাই।
শুনে আগুন হয়ে যায় মজিদ; বলে, পরশু দিন জুম্মাবার, সেদিন যদি দুজনেরই একসাথে খৎনা না হয়, তবে মুশকিল হবে।
একবার একটি ছেলে বলে,—হেই কবে আমার খৎনা হইছে!
তার বাপও মাথা নেড়ে সায় দেয়,–ছোট থাকতেই খৎনা দিছি। মিছা কথা না হুজুর।
কিন্তু মজিদ বিশ্বস্ত সূত্রে শুনেছে, ছেলেটির খৎনা হয়নি। গর্জন করে উঠে বলে,
–তোল লুঙ্গি?
বাপ আবার বলে, খোদার কসম, ওর খৎনা হইছে। কিন্তু তার কথায় কান না দিয়ে মজিদ বিদ্যুৎবেগে ছুটে গিয়ে ধ্যা করে তুলে ফেলে তার লুঙ্গি। ছেলেটি পালাবার উপক্রম করছিল, থাবা দিয়ে তার ঘাড় ধরে ফেলে মজিদ। বোপও পালাই-পালাই করছিল, কিন্তু কীভাবে পালায় ভেবে না পেয়ে ওখানেই বোকার মতো চোখ মেলে বসে থাকে। খানিকক্ষণ বাপ-পুতকে একসঙ্গে গালাগাল করে ছেলেটিকে ধরে নিয়ে এসে মজিদ নিজের বাইরের ঘরে খুটির সঙ্গে বেঁধে রাখে। বলে,