তড়িৎবেগে মজিদ উঠে দাঁড়ায়। ভয়ে তার মুখটা কেমন কালো হয়ে গেছে। দুপা এগিয়ে ওধারে তাকিয়ে সে বলে, বিবি শিলাবৃষ্টি শুরু হইছে!
পরিষ্কার প্রভাতের অপেক্ষায় রহীমা গালে হাত দিয়ে চুপচাপ বসে ছিল। সে কোনো উত্তর দেয় না। মজিদ আরেকটু এগিয়ে যায়, তারপর আবার উৎকণ্ঠিত গলায় বলে,–বিবি, শিলাবৃষ্টি শুরু হইছে!
রহীমা এবারও উত্তর দেয় না। তার আবছা চোখের পানে চেয়ে মনে হয়, সে-চোখ যেন জমিলার সে-দিনকার চোখের মতো হয়ে উঠেছে–যে-দিন সাতকুল খাওয়া খ্যাংটা, বুড়ী এসে আর্তনাদ করেছিল।
এ-দিকে আকাশ থেকে ঝরতে থাকে। পাথরের মতো খণ্ড খণ্ড বরফের অজস্র টুকরো, হয় জমাট বৃষ্টিপাত। দিনের বেলা হলে বাছুরগুলো দিশেহারা হয়ে ছুটত, এক-আধটা হয়তে আঘাত খেয়ে শুয়েও পড়ত। কাদের মিঞার পেটওয়ালা ছাগলটা ডাকতে ডাকতে হয়রান হতো। বউরা আসত বেরিয়ে, ছেলেরা ছুটত বাইরে, লুফে লুফে খেত খোদার ঢিল। কাবণ শয়তানকে তাড়াবার জন্যই তো শিলা ছোড়ে খোদা।
ছেলে-ছোকরার আনন্দ করলেও বয়স্ক মানুষের মুখ কালো হয়ে আসে।–তা দিন-রাতের যখনই শিলাবৃষ্টি হোক না কেন। কারণ মাঠে মাঠে নধর কচি ধান ধ্বংস হয়ে যায়, শিলার আঘাতে তার শীষ ঝরে ঝরে পড়ে মাটিতে। যারা দোয়া-দরূদ জানে তারা তখন ঝড়ের মুখে পড়া নৌকোর যাত্রীদের মতো আকুলকণ্ঠে খোদাকে ডাকে; যারা জানে না। তারা পাথর হয়ে বসে থাকে।
রহীমার কাছে উত্তর না পেয়ে এলেমদার মানুষ মজিদ খোদাকে ডাকতে শুরু করে। একবার ছুটে দরজার কাছে যায়, সর্ষের মতো উঠানে ছেয়ে যাওয়া শিলা দেখে, তারপর আবার দোয়া-দরূদ পড়ে পায়চারি করে দ্রুতপদে। এক সময়ে রহীমার সামনে গিয়ে থমকে দাঁড়ায়। বলে,–কী হইল তোমার? দেখো না শিলাবৃষ্টি পড়ে!
একবার নড়বার ভঙ্গি করে রহীম, কিন্তু তবু কিছু পালে না। পোষা জীবজন্তু একদিন আহার মুখে না দিলে যো-রহীম। অস্থির হয়ে ওঠে দুশ্চিন্তায়, দুটা ভাত অযথা নষ্ট হলে যে আফসোস করে বাঁচে না, সে-ই মাঠে মাঠে কচি-নধর ধান নষ্ট হচ্ছে জেনেও চুপ করে থাকে। এবং যে-রহীমার বিশ্বাস পর্বতের মতো অটল, যার আনুগত্য ধ্রুবতারার মতো অনড়, সে-ই যেন হঠাৎ মজিদের আড়ালে চলে যায়, তার কথা বোঝে না!
মজিদ আবার ওর সামনে গিয়ে থমকে দাঁড়ায়। বিস্মিত কণ্ঠে বলে,–কী হইল তোমার বিবি?
রহীমা হঠাৎ গা ঝাড়া দিয়ে সোজা হয়ে বসে। তারপর স্বামীর পানে তাকিয়ে পরিষ্কার গলায় বলে,–ধান দিয়া কী হইবো, মানুষের জান যদি না থাকে? আপনে ওরে নিয়া আসেন ভিতরে।
কী একটা কথা বলতে গিয়েও মজিদ বলে না। তারপর শিলাবৃষ্টি থামলে সে বেরিয়ে যায়। গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি পড়ছে তখনো, আকাশ এ মাথা থেকে সে-মোথা পর্যন্ত মেঘাবৃত। তবু তা ভেদ করে একটা ধূসর আলো ছড়িয়ে পড়েছে চারধারে।
ঝাপটা খুলে মজিদ দেখল। লাল কাপড়ে আবৃত কবরেব পাশে হাত পা ছড়িয়ে চিৎ হয়ে শুয়ে আছে জমিলা, চোখ বোজা, বুকে কাপড় নেই। চিৎ হয়ে শুয়ে আছে বলে সে-বুকটা বালকের বুকের মতো সমান মনে হয়। আর মেহেদি দেওয়া তার একটা পা কবরের গায়ের সঙ্গে লেগে আছে। পায়ের দুঃসাহস দেখে মজিদ মোটেই ক্রুদ্ধ হয় না; এমন কী তার মুখের একটি পেশীও স্থানান্তরিত হয় না। সে নত হয়ে ধীরে ধীরে দড়িটা খোলে, তারপর তাকে পাঁজাকোল করে ভেতরে নিয়ে আসে। বিছানায় শুইয়ে দিতেই রহীমা স্পষ্ট কণ্ঠে প্রশ্ন করে,—মরছে নাকি?
প্রশ্নটি এই রকম যে, মজিদের ইচ্ছে হয় একটা হুঙ্কার ছাড়ে। কিন্তু কেন কে জানে সে কোনো উত্তর দিতে পারে না! শেষে কেবল সংক্ষিপ্তভাবে বলে,–না। একটি থেমে আস্তে বলে, ওর ঘোর এখনো কাটে নাই। আছের ছাড়লে এই একমটা হয়।
সে-কথায় কান না দিয়ে জমিলার কাছে দাঁড়িয়ে রহীম। তাকে চেয়ে চেয়ে দেখে। তারপর কী একটি। প্রবল আবেগের বশে সে তার দেহে ঘনঘন হাত বুলতে শুরু করে। মায়। যেন ছলছল করে জেগে উঠে হঠাৎ বন্যার মতো দুবাব হয়ে ওঠে, তার কম্পমান আঙিলে সে-বন্যার উচ্ছাস জাগে; তারই আবেগে বার বার বুজে আসে চোখ।
মজিদ। অদূরে বিমূঢ় হয়েই দাঁড়িয়ে থাকে। মুহুর্তের মধ্যে কেয়ামত হবে। মুহুর্তের মধ্যে মজিদের ভেতরেও কী যেন একটা ওলট-পালট হয়ে যাবার উপক্রম করে, একটা বিচিত্র জীবন আদিগন্ত উন্মুক্ত হয়ে ক্ষণকালের জন্য প্ৰকাশ পায় তার চোখের সামনে, আর একটা সত্যের সীমানায় পৌঁছে জন্মবেদনার তীক্ষ্ণ যন্ত্রণা অনুভব করে মনে মনে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত টাল খেয়ে সে সামলে নেয় নিজেকে।
গলা কেশে মজিদ বলে,–দুনিয়াটা বিবি বড় কঠিন পরীক্ষাক্ষেত্র। দয়া-মায়া সকলেরই আছে। কিন্তু তা যেন তোমারে আঁধা না করে।
তারপর সে বেরিয়ে যায়। বেরিয়ে মাঠের দিকে হাঁটতে শুরু করে। ইতিমধ্যে ক্ষেতের প্রান্তে লোক জমা হয়েছে অনেক। কারো মুখে কথা নেই। মজিদকে দেখে কে একজন হাহাকার করে উঠে বলে।–সব তো গেলো! এইবার নিজেই বা খামু কী, পোলাপানদেরই বা দিমু কী?
মজিদের বিনিদ্র মুখটা বৃষ্টিঝরা প্ৰভাতের ম্লান আলোয় বিবৰ্ণ কাঠের মতো শক্ত দেখায়। সে কঠিনভাবে বলে,–নাফরমানি করিও না। খোদার উপর তোয়াক্কল রাখো।
এরপর আর কারো মুখে কথা জোগায় না। সামনে ক্ষেতে ক্ষেতে ব্যাপ্ত হয়ে আছে ঝরে-পড়া ধানের ধ্বংসস্তুপ। তাই দেখে চেয়ে চেয়ে। চোখে ভাব নেই। বিশ্বাসের পাথরে যেন খোদাই সে-চোখ।