তারপর সে বাপ দিয়ে চলে গেলে।
ভেতরে বেড়ার কাছে তখনো দাঁড়িয়ে রহীমা। মজিদকে দেখে সে অক্ষুট কণ্ঠে প্রশ্ন করলে,–হে কই?
–মাজারে। ওর ওপর আছর আছে। মাজারে কিছুক্ষণ থাকলে বাপ-বাপ ডাক ছাড়ি পালাইবো হে-জিন।
—ও ভয় পাইবো না?
হঠাৎ থমকে দাঁড়াল মজিদ। বিস্মিত হয়ে বললে,–কী যে কও তুমি বিবি? মাজার পাকের কাছে থাকলে কিসের ভয়? ভয় যদি কেউ পায় তা ঐ দুষ্ট জিনটাই পাইবো, যে আমার মুখে পর্যন্ত থুথু দিছে। কথাটা মনে হতেই দাঁত কড়মড় করে উঠল মজিদের। দম খিচে ক্ৰোধ সংবরণ করে সে আবার বললে,—তুমি ঘরে গিয়া শোও বিবি।
রহীমা ঘরে চলে গেলো। গিয়ে ঘুমাল কী জেগে রইল তার সন্ধান নেবার প্রয়োজন বোধ করল না মজিদ। মধ্যরাতের স্তব্ধতার মধ্যে সে ভেতরের ঘরের দাওয়ার ওপর চুপচাপ বসে রইল। যে-কোনো মুহূর্তে বাইরে থেকে একটা তীক্ষ্ম আর্তনাদ শোনা যাবে–এই আশায় সে নিজের শ্বসনকে নিঃশব্দ-প্ৰায় করে তুলল। কিন্তু ওধারে কোনো আওয়াজ নেই। থেকে থেকে দূরে প্যাঁচ ডেকে উঠছে, আরো দূরে কোথাও একটা দীঘ গাছের আশ্রয়ে শকুনের বাচ্চ নবজাত মানবশিশুর মতো অবিশ্রান্ত কেঁদে চলেছে, অন্ধকারের মধ্যে একটা বাদুড় থেকে থেকে পাক খেযে যাচ্ছে। রাতটা গুমোট মেরে আছে, গাছের পাতাব নড়াচড় নেই। বাইরে বসেও মজিদের কপালে ঘাম জমছে বিন্দু বিন্দু।
সময় কাটে, ওধারে তবু কোনো আওয়াজ নেই। মুমূর্ষ রোগীর পাশে শেষনিশ্বাস ত্যাগের অপেক্ষায় অনাত্মীয় সুহৃদ লোক যেমন নিশ্চল হয়ে বসে থাকে, তেমনি বসে থাকে৷ মজিদ, গাছের পাতার মতো তারও নড়াচড় নেই।
আরও সময় কাটে। এক সময় মজিদ-বয়সের দোষে বসে থেকেই একটু আলগোছে ঝিমিয়ে নেয়, তারপর দূর আকাশে মেঘগজনি শুনে চমকে উঠে চোখ মেলে তাকায় দিগন্তের দিকে। যে-রাত সেখানে এখন অপেক্ষাকৃত তরল হয়ে আসার কথা সেখানে ঘনীভূত মেঘস্তৃপ। থেকে থেকে বিজলি চমকায়, আর শীঘ্ৰ বিষ্কারবিরে শীতল হওয়া বয়ে আসতে থাকে দক্ষিণ-পশ্চিম কোণ থেকে। দেহের আড়মোড়া ভেঙে সোজা হয়ে বসে মজিদ, মুখে পালকস্পর্শের মতো সে-সিরসিরে শীতল হওয়া বেশ লাগে, এবং সেই আরামে কয়েক মুহূর্ত চোেখও বোজে সে। কিন্তু ক’ন খাড়া হয়ে ওঠার সাথে সাথে ঢোখট ও তার খুলে যায়। সে দেখে না। কিছু, শোনেও লা কিছু! মেঘ দেখা। সারা, এবার সে শুনতে চায়। কিন্তু ওধারে এখনো প্ৰগাঢ় নীরবতা।
আর কতক্ষণ! নড়েচড়ে ভাবে মজিদ, তারপর নিরলস দৃষ্টি দিয়ে দক্ষিণ-পশ্চিম কোণ হতে দ্রুতগতিতে এগিয়ে আসতে থাকা ঘন কালো মেঘের পানে তাকিয়ে থাকে। ইতিমধ্যে রহীমা একবার ছায়ার মতো এসে ঘুরে যায়। ওর দিকে মজিদ তাকায়ও না একবার, না ঘুমিয়ে অত রাতে সে কেন ঘুরছে।-ফিরছে। এ-কথা জিজ্ঞাসা করবারও কোনো তাগিদ। বোধ করে না। তার মনে যেন কোনো প্রশ্ন নেই, নেই অস্থিরতা, অপেক্ষা থাকলেও এবং সে অপেক্ষী যুগযুগ ব্যাপী দীর্ঘ হলেও কোনো উদ্বেগ আসবে না। কিছু দেখবার নেই বলেই যেন সে বসে বসে মেঘ দেখে।
মেঘগর্জন নিকটতর হয়। এবার যখন বিদ্যুৎ চমকায় তখন সারা দুনিয়া ঝলসে উঠে সাদা হয়ে যায়। কয়েক মুহুর্তের জন্য উদ্ভাসিত অত্যুজ্জল আলোর মধ্যে নিজেকে উলঙ্গ বোধ হলেও মজিদ চিবে দুফাঁক হয়ে যাওয়া আকাশ দেখে এ-মাথা থেকে সে-মাথা, তারপর প্যাচার মতো মুখ গোমড়া করে তাকিয়ে থাকে অন্ধকারের পানে। সে-অন্ধকাবে। তবু চোখ পিটপিট করে আশায় আর আকাজক্ষায়। সে-আশা-আকাজক্ষা অবসর উপভোগীর অলস বিলাস মাত্ৰ। চোখ তার পিটপিট করে আর পুনর্বার বিদ্যুৎ চমকানোর অপেক্ষায় থাকে। খোদার কুদবত, প্ৰকৃতির লীলা দেখবাব জন্যই যেন সে বসে আছে ঘুম না গিয়ে, আরাম না। কোরে। হয়তো-বা। সে এবাদত করে। এবাদতের রকমের শেষ নেই। প্ৰকৃতির লীলা চেয়ে চেয়ে দেখাও এক রকম এবাদত।
আসন্ন ঝড়ের আশঙ্কায় আকাশ অনেকক্ষণ থমথম ক্রে। রাতও কাটি-কাটি করে কাটে না, পাড়াগাঁয়ের থিয়েটারের যবনিকার মতো সময় পেরিয়ে গেলেও রাত্ৰির যবনিকা ওঠে না। প্ৰকৃতি-অবলোকনোর এবাদতই যদি কোরে থাকে মজিদ। তবে ঈষৎ বিরক্তি ধরে যেন, কারণ ভ্রূর কাছটা একটু কুঁচকে যায়।
তারপর হঠাৎ ঝড় আসে; দেখতে না দেখতে সারা আকাশ ছেয়ে যায় ঘন কালো মেঘে, তীব্র হওয়ার ঝাপটায় গাছপালা গোঙায়, থবথর কোরে কঁপে মানুষের বাডিঘর। মজিদ উঠে আসে ভেতবে। ভাবে, ঝড় থামুক। কারণ আব্ব দেরী নয়, ওধাবে মেঘের আড়ালে প্ৰভাত হয়েছে। সুবোহ সাদেক। নিৰ্মল, অতি পবিত্র তার বিকাশ। যে রাতে অসংখ্য দুষ্ট আত্মারা ঘুরে বেড়ায় সে-রাতের শেষ; নোতুন দিনের শুরু। মজিদের কণ্ঠে গানের মতো গুনগুনিয়ে ওঠে পাঁচ পদের ছুরা আল-ফালাক। সন্ধ্যার আকাশে অস্তগামী সূর্য দ্বারা ছড়ানো লাল আভাকে যে-কুৎসিত ভয়াবহ অন্ধকার মুছে নিশ্চিহ্ন করে দেয়, সেঅন্ধকারের শয়তানি থেকে আমি আশ্রয় চাই, চাই তোমারই কাছে হে খোদা, হে প্ৰভাবে মালিক। আমি বাঁচতে চাই যাত অন্যায় থেকে, শয়তানের মায়াজাল থেকে আর যত দুর্বলতা থেকে, হে দিনাদির অধিকারী।
এ-দিকে প্ৰভাতের বাহ্যিক লক্ষণ দেখা যায় না। ঝড়ের পরে আসে জোব ল বৃষ্টি। ভ্ৰাসংখ্য তীরের ফলার মতো সে-বৃষ্টি বিদ্ধ করে মাটিকে! তারপর “অপ্ৰত্যাশিতভাবে আসে শিলাবৃষ্টি। মজিদের ঢেউ-তোলা টিনের ছাদে যখন পথভ্ৰষ্ট উষ্কার মতো প্ৰথম শিলাটি এসে পড়ে তখন হঠাৎ মজিদ সোজা হয়ে উঠে বসে, কান তার খাড়া হয়ে ওঠে বিপদসঙ্কেত শুনে। শীঘ্ৰ অজস্র শিলাবৃষ্টি পড়তে শুরু করে।