মজিদ রহীমার চীৎকার শুনল কী শুনল না, কিন্তু ওধারে তাকাল না, কোনো কথাও বলল না। আরো কিছুক্ষণ সে স্তম্ভিতভাবে দাঁড়িয়ে থেকে হঠাৎ হাতকাটা ফতুয়ার নিম্নাংশ দিয়ে মুখটা মুছে ফেলল। ইতিমধ্যে তার ডান হাতের বজকঠিন মুঠোর মধ্যে জমিলার হাতটি টিলা হয়ে গেছে; সে-হা ৩ ছাড়িয়ে নেবার আর চেষ্টা নেই, বন্দী হয়ে আছে বলে প্ৰতিবাদ নেই। তার হাতের লাইট্টা মাছের মতো হাড়গোডহীন তুলতুলে নরম ভাব দেখে মজিদ অসতর্ক হবার কোনো কারণ দেখল। না। সে নিজের বজমুষ্টিকে আরো কঠিনতর করে তুলল। তারপর হঠাৎ দু-পা এগিয়ে এসে এক নিমেষে তাকে পাজকেল করে শূন্যে তুলে আবার দ্রুতপায়ে ঠাঁটতে লাগল, বাইরের দিকে। ভেবেছিল, হাত-পা ছোড়াছুড়ি করবে। জমিলা, কিন্তু তার ক্ষুদ্র অপরিণত দেহটা নেতিয়ে পড়ে থাকল মজিদের অর্ধচক্রাকারে প্রসারিত দুই বাহুতে। এত নরম তার দেহের ঘনিষ্ঠত যে তারার ঝালকানির মতো এক মুহূর্তের জন্য মজিদের মনে ঝলকে ওঠে একটা আকুলতা; তা তাকে তার বুকের মধ্যে ফুলের মতো নিষ্পেষিত করে ফেলবার। কিন্তু সে-ক্ষুদ্র লতার মতো মেয়েটির প্রতিই ভয়টা দুৰ্দান্ত হয়ে উঠল। এবারেও সে অসতর্ক হলো না। এখন গা-ঢেলে নিস্তেজ হয়ে থাকলে কী হবে বিষাক্ত সাপকে দিয়ে কিছু বিশ্বাস নেই।
জমিলাকে সোজা মাজার-ঘরে নিয়ে ধপাস করে তার পাদপ্রান্তে বসিয়ে দিলে মজিদ। ঘর অন্ধকার। বাইরে থেকে আকাশের যে অতি মান আলো আসে তা মাজার-ঘরের দরজাটিবে ই কেবল রেখায়িত করে রাখে, এখানে সে আলো পৌছায় না। এখানে যেন মৃত্যুর আর ভিন্ন অপরিচিত দুনিয়ার অন্ধকার; সে-অন্ধকারে সূর্য নেই, চাদ–তারা নেই, মানুষের কুপি-লণ্ঠন বা চকমকির পাথর নেই। খুন হওয়া মানুষের তীক্ষ্ণ আর্তনাদ শুনে অন্ধের চোখে দৃষ্টির জন্য যে-তীব্র ব্যাকুলতা জাগে তেমনি একটা ব্যাকুলতা জাগে অন্ধকারের গ্রাসে জ্যোতিহীন জমিলার চোখে। কিন্তু সে দেখে না কিছু। কেবল মনে হয়, চোখের সামনে অন্ধকারই যেন অধিক তাঁর গাঢ় হয়ে রয়েছে।
তারপর হঠাৎ যেন ঝড় ওঠে। অদ্ভুত ক্ষিপ্ৰতায় ও দুবন্ত বাতাসের মতো বিভিন্ন সুরে মজিদ দোয়া-দরূদ পড়তে শুরু করে। বাইরে আকাশ নীরব, কিন্তু ওর কণ্ঠে জেগে ওঠ দুনিয়ার যত অশান্তি আর মরণভীতি, সর্বনাশা ধ্বংস থেকে বাঁচবার তীব্র ব্যাকুলত।
মজিদের কণ্ঠের ঝড় থামে না। জমিলা স্তব্ধ হয়ে বসে তাকিয়ে থাকে সামনের দিকে, মাছের পিঠের মতো একটা ঘনবর্ণ স্তৃপ রেখায়িত হয়ে ওঠে সামনে। মাজারের অস্পষ্ট চেহারার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে জমিলার ভীত-চঞ্চল মনটা কিছু স্থির হয়ে এসেছে এমনি সময়ে বুক ফাট কণ্ঠে মজিদ হে। হে করে উঠল। তার দুঃখের তীক্ষ্ণ তার সে কী ধার। অন্ধকারকে যেন চিড়াচড় করে দুফাঁক করে দিলে। সভয়ে চমকে উঠে জমিলা তাকাল স্বামীর পানে। মজিদের কঠে। তখন আবার দোয়া-দরূদের ঝড় জেগেছে, আর ঝড়ের মুখে পড়া ক্ষুদ্রপল্লবের মতো ঘূর্ণমান তার অশান্ত উদভ্ৰান্ত চোখ।
একটু পরে হঠাৎ জমিলা আর্তনাদ করে উঠল। আওয়াজটা জোরাল নয়, কারণ একটা প্ৰচণ্ড ভীতি তার গলা দিয়ে যেন আস্ত হাত ঢুকিয়ে দিয়েছে। তারপর সে চুপ করে গেলো। কিন্তু ঝড়ের শেষ নেই। ওঠা-নমা আছে, দিক পরিবর্তন আছে, শেষ নেই। এবং শেষ নেই বলে মানুষের আশ্বাসের ভরসা নেই।
ধাঁ করে জমিলা উঠে দাঁড়াল। কিন্তু মজিদও ক্ষিপ্ৰভাবে উঠে দাঁড়াল। জমিলা দেখল পথ বন্ধ। যে-ঝড়ের উদ্দামতার জন্য নিশ্বাস ফেলবার যে নেই; সে-ঝড়ের আঘাতেই ডালপালা ভেঙে পথ বন্ধ হয়ে গেছে। একটু দূরে খোলা দরজা, তারপর অন্ধকার আর তারাময় আকাশের অসীমতা। এইটুকুন পথ পেরোবার উপায় নেই।
জমিলাকে বসিয়ে কিছুক্ষণের জন্য দোয়া-দবাদ পড়া বন্ধ করে মজিদ। এই সময় সে বলে,–দেখো আমি যেই ভাবে বলি সেইভাবে কর। আমার হাত হইতে দুষ্ট আত্মা, ভূত-প্রেতও রক্ষা পায় নাই। এই দুনিয়ার মানুষরা যেমন আমারে ভয় করে শ্রদ্ধা করে, তেমনি ভয় করে, শ্রদ্ধা করে অন্য দুনিয়ার জিন-পরীরা। আমার মনে হইতেছে, তোমার ওপর কারো আছর আছে। না হইলে মাজার পাকের কোলে বইসাও তোমার চোখে এখনো পানি আইল না কেন, কেন তোমার দিলে একটু পাশেমানির ভাব জাগল না? কেনই-বা মাজার পাক তোমার কাছে আগুনের মতো অসহ্যু লাগিতাছে?
এই বলে সে একটা দড়ি দিয়ে কাছাকাছি একটা খুটির সঙ্গে জমিলার কোমর বাঁধল। মাঝখানের দড়িটি টিলা রাখল, যাতে সে মাজারের পাশেই বসে থাকতে পারে। তারপর ভয়ে অসাড় হয়ে যাওয়া জমিলার দিকে শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,—তোমার জন্য আমার মায়া হয়। তোমারে কষ্ট দিতেছি তার জন্য দিলে কষ্ট হইতেছে। কিন্তু মানুষের ফোড়া হইলে সে-ফোড়া ধারাল ছুরি দিয়া কাটতে হয়, জিনের আছর হইলে বেত দিয়া চাবকাইতে হয়, চোখে মরিচ দিতে হয়। কিন্তু তোমারে আমি এই সব করুম না। কারণ মাজার পাকের কাছে রাতের এক প্রহর থাকলে যতই নাছোড় বান্দা দুষ্ট আত্মা হোক না কেন, বাপ-বাপ। ডাক ছাড়ি পলাইবো। কাইল তুমি দেখবা দিলে তোমার খোদার ভয় আইছে, স্বামীর প্রতি ভক্তি আইছে, মনে আর শয়তানি নাই।
মনে মনে মজিদ আশঙ্কা করেছিল, জমিলা হঠাৎ তারস্বরে কঁদতে শুরু করবে। কিন্তু আশ্চৰ্য, জমিলা কাঁদলও না, কিছু বললেও না, দরজার পানে তাকিয়ে মূর্তির মতো বসে রইল। কয়েক মুহূর্ত তার দিকে সন্ধানী দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে সে গলা উঁচিয়ে বলল,—ঝাপটা দিয়া গেলাম। কিন্তু তুমি চুপ কইরা থাইকো না। দোয়াদরূদ পড়ো, খোদার কাছে আর তানার কাছে মাফ চাও।