রহীমা কিছুক্ষণের জন্য স্বতঃপ্ৰবৃত্ত হয়ে স্বামীর পা টেপে। হাড়সম্বল কঠিন পা, মৃতের মতো শীতল শুষ্ক তার চামড়া। কিন্তু গভীর ভক্তিভরে সে-পা টেপে রহীমা, ঘুণধরা হাড়ের মধ্যে যে-ব্যথার রস টনটন করে, তার আরাম করে।
সুখভোগ নীরবেই করে মজিদ। হুঁকায় তেজ কমে এসেছে, তবু টেনে চলে। কানটা ওধারে। নীরবতার মধ্যে ওঘর হতে থেকে থেকে কঁচের চুড়ির মৃদু ঝঙ্কার ভেসে আসে। সে কান পেতে শোনে সে ঝঙ্কার।
সময় কাটে। রাত গভীর হয়ে ওঠে বাঁশঝাড়ে, গাছের পাতায় আর মাঠে-ঘাটে। একসময়ে রহীমা আস্তে উঠে চলে যায়। মজিদের চোখেও একটু তন্দ্রার মতো ভাব নামে। একটু পরে সহসা চমকে জেগে উঠে সে কান খাড়া করে। ওধারে পরিপূর্ণ নীরবতা।–সে-নীরবতার গায়ে আর চুড়ির চিকন আওয়াজ নেই।
ধীরে ধীরে মজিদ ওঠে। ওঘরে গিয়ে দেখে, জায়নামাজের ওপর জমিলা সেজদা দিয়ে আছে। এখুনি উঠবে–এই অপেক্ষায় কয়েক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে থাকে মজিদ। জমিলা কিন্তু ওঠে না।
ব্যাপারটা বুঝতে এক মুহুর্ত বিলম্ব হয় না। মজিদের। নামাজ পড়তে পড়তে সেজদায় গিয়ে হঠাৎ সে ঘুমিয়ে পড়েছে। দস্যুর মতো আচমকা এসেছে সে-ঘুম, এক পলকের মধ্যে কাবু করে ফেলেছে তাকে।
কয়েক মুহূর্ত চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে মজিদ, বোঝে না। কী করবে। তারপর সহসা আবার সেই চিনচিনে ক্ৰোধ তার মাথাকে উত্তপ্ত করতে থাকে। নামাজ পড়তে পড়তে যার ঘুম এসেছে তার মনে ভয় নেই। এ-কথা স্পষ্ট। মনে নিদারুণ ভয় থাকলে মানুষের ঘুম আসতে পারে না কখনো। এবং এত কোরেও যার মনে ভয় হয়নি, তাকেই এবার ভয় হয় মজিদের।
হঠাৎ দ্রুত পদে এগিয়ে গিয়ে সেদিনকার মতো এক হাত ধরে হ্যাচক টান মেরে বসিয়ে দেয় জমিলাকে। জমিলা চমকে উঠে তাকায় মজিদের পানে, প্ৰথমে চোখে জাগে ভীতি, তারপর সে-চোখ কালো হয়ে আসে।
মজিদ গোঁ গোঁ করে ক্ৰোধে। রাতের নীরবতা এত ভারী যে, গলা ছেড়ে চীৎকার করতে সাহস হয় না, কিন্তু একটা চাপা গর্জন নিঃসৃত হয় তার মুখ দিয়ে। যেন দূর আকাশে মেঘ গৰ্জন করে গড়ায়, গড়ায়।
–তোমার এত দুঃসাহস? তুমি জায়নামাজে ঘুমাইছ? তোমার দিলে একটু ভয়ডর হইবো না?
জমিলা হঠাৎ থারথার করে কাঁপিতে শুরু করে। ভয়ে নয়, ক্ৰোধে। গোলমাল শুনে রহীমা পাশের বিছানা থেকে উঠে এসেছিল, সে জমিলার কঁপুনি দেখে ভাবল দুরন্ত ভয় বুঝি পেয়েছে মেয়েটার। কিন্তু গর্জন করছে মজিদ, গর্জন করছে খোদাতালার ন্যায়বাণী, তাঁর নাখোশ দিল। মজিদের ক্ৰোধ তো তাঁরই বিদ্যুৎচ্ছটা, তাঁরই ক্ৰোধের ইঙ্গিত। কী আর বলবে রহীমা। নিদারুণ ভয়ে সেও অসাড় হয়ে যায়। তবে জমিলার মতো কাঁপে না।
বাক্যবাণ নিৰ্ম্মফল দেখে আরেকটা হ্যাচক টান দেয় মজিদ। শোয়া থেকে আচমকা একটা টানে যে উঠে বসেছিল, তাকে তেমনি একটা টান দিয়ে দাঁড় করাতে বেগ পেতে হয় না। ববঞ্চ কিছু বুঝে উঠবার আগেই জমিলা দেখে যে, সে দাঁড়িয়ে আছে, যদিও খুব শক্তভাবে নয়। তারপর সে আপন শক্তিতে সুস্থির হয়ে দাড়াল, এবং কাঁপিতে থাকা ঠোঁটকে উপেক্ষা করে শান্ত দৃষ্টিতে একবার নিজের ডান হাতের কঞ্জিব পানে তাকাল। হয়তো ব্যথা পেয়েছে। কিন্তু ব্যথার স্থান শুধু দেখল। তাতে হাত বুলাল না। বুলাবার ইচ্ছে থাকলেও অবসর পেল না। কারণ আরেকটা হ্যাচক টান দিয়ে মজিদ তাকে নিয়ে চললে বাইরের দিকে।
উঠানটা তখনো পেরোয়নি, বিভ্ৰান্ত জমিলা হঠাৎ বুঝলে, কোথায় সে যাচ্ছে। মজিদ তাকে মাজারে নিয়ে যাচ্ছে। তারাবির নামাজ পড়ে মাজারে গিয়ে মাফ চাইতে হবে সে-কথা মজিদ আগেই বলেছিল, এবং সেই থেকে একটা ভয়ও জেগে উঠেছিল জমিলার মনে। মাজারের ত্ৰিসীমানায় আজ পর্যন্ত ঘেষেনি সে। সকালে আজ মজিদ যে-গল্পটা বলেছিল, তারপর থেকে মাজারের প্রতি ভয়টা আরো ঘনীভূ৩ হয়ে উঠেছে।
মাঝ-উঠানে হঠাৎ বেঁকে বসল জমিলা। মজিদের টানে স্রোতে ভাসা তৃণখণ্ডের মতো ভেসে যাচ্ছিল, এখন সে সমস্ত শক্তি সংযোগ করে মজিদের বজ্রমুষ্টি হতে নিজের হাতটা ছাড়িয়ে নেবার চেষ্টা করতে লাগল। অনেক চেষ্টা করেও হাত যখন ছাড়াতে পারল না। তখন সে অদ্ভুত একটা কাণ্ড করে বসল। হঠাৎ সিধে হয়ে মজিদের বুকের কাছে এসে পিচ কবে তাঁর মুখে থুথু নিক্ষেপ করল।
পেছনে পেছনে রহীমা আসছিল কম্পিত বুক নিয়ে। আবছা অন্ধকারে ব্যাপারটা ঠিক ধরতে পারল না; এও বুঝল না, মজিদ আমন বজ্রাহত মানুষের মতো ঠায় দাঁড়িয়ে রয়েছে কেন। কিছু না বুঝে সে বুকের কাছে আঁচল শক্ত করে ধরে থ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল।
মজিদ যেন সত্যি বজ্রাহত হয়েছে। জমিলা এমন একটা কাজ করেছে যা কখনো স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি। কেউ করতে পারে। যার কথায় গ্রাম ওঠে-বসে, যার নির্দেশে খালেক ব্যাপারীর মতো প্ৰতিপত্তিশালী লোকও বউ তালাক দেয়। দ্বিরুক্তি মাত্র না করে, যার পা খোদিভাবমত্ত লোকেরা চুম্বনে চুম্বনে সিক্ত করে দেয়, তার প্রতি এমন চরম অশ্রদ্ধা কেউ দেখাতে পারে সে-কথা ভাবতে না পারাই স্বাভাবিক।
হঠাৎ অন্ধকার ভেদ করে মজিদ রহীমার পানে তাকাল। তাকিয়ে অদ্ভুত গলায় বলল,—হে আমার মুখে থুথু দিলো!
একটু পরে অন্ধকার থেকে তীক্ষ্ণকণ্ঠে আর্তনাদ করে উঠল রহীমা,–কী করলা বইন তুমি, কী করলা!
তার আর্তনাদে কী ছিল কে জানে, কিন্তু ক্ৰোধে থারথার করে কাঁপিতে থাকা জমিলা হঠাৎ স্তব্ধ হয়ে গেলে মনে-প্ৰাণে। কী একটা গভীর অন্যায়ের তীব্ৰতায় খোদার আরশ পর্যন্ত যেন কেঁপে উঠেছে।