জিকির করতে করতে মজিদ অজ্ঞান হয়ে পড়েছে। এ হয়েই থাকে। তবু লোকেরা তাকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। কেউ হাওয়া করে, কেউ বুকফাটা আওয়াজে হা-হা কোরে আফসোস করে, কেউ বা এ-হট্টগোলের সুযোগে মজিদের অবশ্য পদযুগল মত্ত চুম্বনে চুম্বনে সিক্ত কোরে দেয়। কেবল ক্ষয়ে আসা মোমবাতি দুটো তখনো নিষ্কম্প স্থিরতায় উজ্জ্বল হয়ে থাকে।
হঠাৎ একটি লোকের নজর বাইরের দিকে যায়। কেন যায় কে জানে, কিন্তু বাইরে গাছতলার দিকে তাকিয়ে সে মুহুর্তে স্থির হয়ে যায়। কে ওখানে? আলিঝালি দেখা যায়, পাতলা একটি মেয়ে, মাথায় ঘোমটা নেই। সে আর দৃষ্টি ফেরায় না। তারপর একে একে অনেকেই দেখে। তবু মেয়েট নড়ে না। অস্পষ্ট অন্ধকারে ঘোমটাশূন্য তার মুখটা ঢাকা চাঁদের মতো। রহস্যময় মনে হয়।
শীঘ্ৰ মজিদের জ্ঞান হয়। ধীরে ধীরে সে উঠে বসে তারপর চোখে অর্থহীন অবসাদ নিয়ে ঘুরে ঘুরে সবার দিকে তাকায়। এক সময়ে সেও দেখে মেয়েটিকে। সে তাকায়, তারপর বিমূঢ় হয়ে যায়। বিমূঢ়তা কাটলে দপ কোরে জ্বলে ওঠে চোখ।
অবশেষে কী কোরে যেন মজিদ সরল কণ্ঠে হাসে। সকল দিকে চেয়ে বলে,–পাগলী ঝিট। একটু থেমে আবার বলে, নোতুন বিবির বাড়ির লোক, তার সঙ্গে আসছে।
তারপর হাততালি দিয়ে উচু গলায় মজিদ হাঁকে, এই বিটি ভাগ! ঠোঁটে তখনো হাসির রেখা, কিন্তু সে-দিকে তাকিয়ে চোখ তার দপদপ করে জ্বলে।
হয়তো তার চোখের আগুনের হল্কা লেগেই ঘোর ভাঙে জমিলার। হঠাৎ সে ভেতরের দিকে চলতে থাকে, তারপর শীঘ্ৰ বেড়ার আড়ালে অদৃশ্য হয়ে যায়।
আবার জিকির শুরু হয়। কিন্তু কোথায় যেন ভাঙন ধরেছে, জিকির আর জমে না। লোকের মাথা দোলায় বটে। কিন্তু থেকে থেকে তাদের দৃষ্টি বিদ্যুৎ-ক্ষিপ্ৰতায় নিক্ষিপ্ত হয় গাছতলার দিকে। কঙালের মতো তাদের দৃষ্টি কী যেন হাতড়ায়। মহাসমুদ্রের ডাককে অবহেলা কোরে বালুতীরে কী যেন খোঁজে।
অবশেষে মজিদ মুখ তুলে তাকায়। জিকিরের ধ্বনিও সেই সঙ্গে থামে। ক্ষয়িষ্ণু মোমবাতি দুটো নিষ্কম্পভাবে জ্বলে, কিন্তু আগরবাতির কাঠিগুলো চালের মধ্যে কখন গুঁড়িয়ে ভস্ম হয়ে আছে।
কিছু বলার আগে মজিদ একবার কাশে। কেশে একে একে সকলের পানে তাকায়। তারপর বলে,–ভাই সকল, আমার মালুম হইতেছে কোনো কারণে আপনারা বেচইন আছেন। কী তার কারণ?
কেউ উত্তর দেয় না। কেবল উত্তর শোনার জন্য তারা পরস্পরের মুখের দিকে চাওয়া-চাওয়ি করে। কতক্ষণ অপেক্ষা করে মজিদ তারপর বলে,–আইজ জিকির ক্ষান্ত হইল।
খাওয়া-দাওয়া শুরু হয়। অন্যান্য দিন জিকিরের পর লোকেরা প্ৰচণ্ড ক্ষিধে নিয়ে গোগ্রাসে খিচুড়ি গেলে, আজ কিন্তু তেমন হাত চলে না তাদের। কিসের লজ্জায় সবাই মাথা নিচু করে রেখেছে, আর কেমন বিসদৃশভাবে চুপচাপ।
নিবন্ত চুলার পাশে রহীম। তখনো বসে আছে, পাশে নামিয়ে রাখা খিচুড়ির ডেকচি। বুড়ো আওলাদ অন্দরে-বাইরে আসা-যাওয়া করে। এবার খালি বর্তন নিয়ে আসে ভেতরে।
একটু পরে মজিদও আসে। রহীমা আলগোছে ঘোমটা টেনে সিধা হয়ে বসে। ভাবে, রান্না ভালো হলো কী খারাপ হলো এইবার মতামত জানাবে মজিদ। কাছে এসে মজিদ। কিন্তু রান্না সম্পর্কে কোনো কথাই বলে না। কেমন চাপ কৰ্কশ গলায় প্রশ্ন করে,–হে কই?
রহীমা চারধারে তাকায়। কোথাও জমিলা নেই। মনে পড়ে, তখন সে যে হঠাৎ উঠে চলে গেলো তারপর আর সে এ-দিকে আসেনি। আস্তে রহিমা বলে,–বোধ হয় ঘুমাইছে।
দাঁত কিড়ামিড় কোরে এবার মজিদ বলে,–ও যে একদম বাইরে চইলা গেলো, দেখলা না তুমি?
মুহুর্তে ভয়ে স্তব্ধ হয়ে যায় রহীম। জমিলা বাইরে গিয়েছিল? কতক্ষণ অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে স্বামীর দিকে তাকিয়ে থেকে গালে হাত দিয়ে
প্ৰশ্ন করে,–হে বাইরে গেছিল?
তখনো দাঁত কিড়মিড় করে মজিদের। উত্তরে শুধু বলে,–হ!
তারপর হনহানিয়ে ভেতরে চলে যায়। রহীমা অনেকক্ষণ চুপ হয়ে বসে থাকে। তার হাত-পা কেমন যেন অসাড় হয়ে আসে।
পরে সে-দিনকার মতো জমিলাকে ডাকতে সাহস হয় না। নিবন্ত হুঁকাটা পাশে নামিয়ে রেখে সিড়ির কাছাকাছি গুম হয়ে বসে ছিল মজিদ। তার দিকে চেয়ে ভয় হয় যে, ডাকার আওয়াজে সহসা সে জেগে উঠবে, চাপা ক্ৰোধ হঠাৎ ফেটে পড়বে, নিশ্বাসরুদ্ধ-করা আশঙ্কার মধ্যে তবু যে-নীরবতা এখনো অক্ষুন্ন আছে তা ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যাবে। তাই উঠানটা পেরুতে গিয়ে সতর্কভাবে হাটে রহীম, নিঃশব্দে আর আলাগোছে। কিন্তু এ-দিকে তার মাথা বিমঝিম করে। জমিলার বাইরে যাওয়ার কথা যখনই ভাবে তখনই তার মাথা ঝিমঝিম কোরে ওঠে। মনে মনে কেমন ভীতিও বোধ করে। লতার মতো মেয়েটি যেন এ-সংসারে ফাটল ধরিয়ে দিতে এসেছে। ঘরে সে যেন বালা ডেকে আনবে। আর মাজার-পাকের দোয়ায় যে-সংসার গড়ে উঠেছে সে-সংসার ধূলিসাৎ হয়ে যাবে।
ওদিক থেকে রহীমা সিড়ির দিকে এলে মজিদ হঠাৎ ডাকেবিবি, শোনো! তোমার লগে কথা আছে।
সে নিরুত্তরে পাশে এসে দাড়ালে মজিদ মুখ তুলে তাকায় তার পানে। সংকীর্ণ দাওয়ার ওপর একটি কুপি বসানো। তার আবছা আলো কয়েক হাত দূরে দাঁড়িয়ে থাকা রহীমার মুখকে অস্পষ্ট কোরে তোলে। সে-দিকে তাকিয়ে মজিদের ঠোঁট যেন কেমন থর থর কোবে কেঁপে ওঠে।–বিবি, কারে বিয়া করলাম? তুমি কী বদদোয়া দিছিলা নি?
শেষোক্ত কথাটা তড়িৎবেগে আহত করে রহীমাকে। তৎক্ষণাৎ সে ক্ষুঃ কণ্ঠে উত্তর দেয়,–তওবা-তাওবা, কী যে কেন। কিন্তু তারপর তার কথা গুলিয়ে যায়। মুখ তুলে তাকিয়েই থাকে মজিদ। অস্পষ্ট আলোর মধ্যে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে রহীম। মুখের একপাশে গাঢ় ছায়া, চোখ দুটো ভেজা মাটির মতো নরম। মৃত্যুর্তের মধ্যে মজিদ উপলব্ধি করে যে, চওড়া ও রঙ-শূন্য নিম্পূহ মানুষ রহীমা মনে নেশা না জাগালেও তারই ওপর সে নির্ভর করতে পারে। তার আনুগত্য এপ্রুবতারার মতো অনড়, তার বিশ্বাস পর্বতের মতো অটল। সে তার ঘরের খুটি।