কিন্তু পরমুহূর্তেই শান্ত হয়ে অধিকতর মনোযোগ সহকারে জমিলা সিঁথি কাটতে থাকে।
সে-দিন বাদ-মগরের শিরনি চড়ানো হবে। যে-দিন শিরনি চড়ানো হবে বলে মজিদ ঘোষণা করে সে-দিন সকাল থেকে লোকেরা চাল-ডাল মশলা পাঠাতে শুরু করে। সে-চাল-ডাল মজিদ ছুয়ে দিলে রহীমা তা দিয়ে খিচুড়ি রাধে। অন্দরের উঠানে সে-দিন কাটা চুলায় ব্যাপারীর বড় বড় ডেকচিতে বান্না হতে থাকে। ওদিকে বাইরে জিকির হয়। জিকিরের পর খাওয়া-দাওয়া।
মজিদ পুকুরঘাট থেকে ফিরে এলে প্ৰথম চাল-ডাল-মশলা এল ব্যাপারীর বাড়ি থেকে। সেই শুরু। তারপর একসের-আধাসের কোরে নানাবাড়ি থেকে তেমনি চাল-ডাল-মশলা আসতে থাকে। অপরাহের দিকে অন্দরে উঠানে চুলা কাটা হলো। শীঘ্ৰ সে-চুলা গানগন কোরে উঠবে আগুনে।
মগরেবের পর লোকেরা এসে বাহিরা-ঘরে জমতে লাগল। কে একজন মোমবাতি এনেছে কটা, তাছাড়া আগরবাতিও এনেছে এক গোছা। বিছানো সাদা চাদরের ওপর মজিদ বসলে তার দুপাশে রাখা হলো দুটো দীর্ঘ মোমবাতি, আর সামনে এক গোছা আগরবাতির জ্বলন্ত কাঠি। কাঠিগুলো একভাণ্ড চালের মধ্যে বসানো।
মজিদ আজ লম্বা সাদা আলখাল্লা পরেছে। পিঠ টান করে হাঁটু গেড়ে বসে সেটা গুজে দিয়েছে পায়ের নিচে পর্যন্ত। আর মাথায় পরেছে আধা পাগড়ি, পেছন দিকটায় তার বিঘৎ খানেক লেজ।
যথেষ্ট দোয়া-দরূদ পাঠের পর জিকির শুরু হয়। প্ৰথমে অতি ধীরে ধীরে প্রশান্ত সমুদ্রের বিলম্বিত ঢেউয়ের মতো। কারণ লোকেরা তখন পরস্পরের নিকট হতে দূরে দূরে ছড়িয়ে আছে যোগশূন্য হয়ে। কিন্তু এই যোগশূন্যতার মধ্যে এ-কথা স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, পরস্পরের সঙ্গে মিলিত হবার জন্যই তারা ভাসতে শুরু করেছে, উঠতে-নামতে শুরু
করেছে।
টিমেতে তাল ঢেউয়ের মতো ভাসতে ভাসতে তারা ক্রমশ এগিয়ে আসতে থাকে পরস্পরের সন্নিকটে .। এ-ধীরগতিশীল অগ্রসর হবার মধ্যে চাঞ্চল্য নেই এখনো, আশা-নিরাশার দ্বন্দ্বও নেই। খোদার অস্তিত্বের মতো তাদের লক্ষ্যের অবস্থান সম্পর্কে একটা নিরুদ্বিগ্ন বিশ্বাস।
সন্ধ্যাটি হাওয়াশূন্য। মোমবাতির শিখা স্থির ও নিষ্কম্প। অদূরে সালু কাপড়ে আবৃত মাছের পিঠের মতো মাজারটি মহাসত্যের প্রতীক স্বরূপ অটুট জমাট পাথরে নীরব, নিশ্চল।
কিন্তু ধীরে ধীরে এদের গলা চড়তে থাকে। ক্রমে ক্ৰমে দুনে চড়ে জিকির। প্ৰত্যেকে পরস্পরের সন্নিকটে আসতে থাকে, এবং যে-মহা অগ্নিকুণ্ডের স্মৃষ্টি হবে শীঘ্ৰ, তারই ছিটেফোটা ফুলিঙ্গ জ্বলে ওঠে ঘনিষ্ঠতার সংঘর্ষণে।
মজিদের চোখ ঝিমিয়ে আসে। সঙ্গে সঙ্গে বারবার দেহ ঝুকে আসে। মুখের কথা আধা বুকে বিধে যায় আর তার অন্তর-খনন গভীরতর হতে থাকে। ভেতর থেকে ক্রমশ বলকে-বলকে একটা অস্পষ্ট, বিচিত্র আওয়াজ বেরোয় শুধু। আর কতক্ষণ? পরস্পরের দাহ্য-চেতনা এইবার মিলিত হবে-হচ্ছে করছে। একবার হলে মুহুর্তে সমস্ত কিছু মুছে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে, দুনিয়ার মোহ আর ঘরবসতির মায়া-মীম তা জ্বলে ছরখার হয়ে যাবে।
আওয়াজ বিচিত্ৰতর হতে থাকে। হু হু হু। আবার; হু হু হু। আবার…
অন্দরে উঠানে মজিদ নিজের হাতে যে-শিরনি চড়িয়ে এসেছে, তার তদারক করার ভার রহীমা-জমিলার ওপর। চাদহীন রাতে ঘন অন্ধকারের গায়ে বিরাট চুলা গানগন করে, আর কালো হাওয়া ভালো চালের মিহি-মিষ্টি গন্ধে ভুরভুর করে।
কাজের মধ্যে জমিলা উবু হয়ে বসে হাঁটুতে থুতনি রেখে বড় ডেকচিটাতে বলক-ওঠা চেয়ে চেয়ে দেখে। সাহায্য করতে পাড়ার মেয়েরা যারা এসেছে তারা অশরীরীর মতো নিঃশব্দে ঘুরে ঘুরে কাজ করে। ধোয়া-পাকলা করে, লাকড়ি ফাড়ে, কিন্তু কথা কয় না কেউ।
বাইরে থেকে ঢেউ আসে জিকিরের। ডেকচিতে বলক আসা দেখে জমিলা, আর সে-ঢেউয়ের গর্জন কান পেতে শোনে। সে-ঢেউ যখন ক্রমশ একটা অবক্তব্য উত্তাল ঝড়ে পরিণত হয় তখন এক সময়ে হঠাৎ কেমন বিচলিত হয়ে পড়ে জমিলা। সে-ঢেউ তাকে আচম্বিতে এবং অত্যন্ত রূঢ়ভাবে আঘাত করে। তারপর আঘাতের পর আঘাত আসতে থাকে। একটা সামলিয়ে উঠতে না উঠতে আরেকটা। সে আর কত সহ্য করবে! বালুতীরে যুগযুগ আঘাত পাওয়া শক্ত-কঠিন পাথর তো সে নয়। হঠাৎ দিশেহারা হয়ে সে পিঠ সোজা কোরে বসে, তারপর বিভ্ৰান্ত দৃষ্টিতে এধার-ওধার চেয়ে শেষে রহীমার পানে তাকায়। গনগনে আগুনের পাশে কেমন চওড়া দেখায় তাকে, কিন্তু কানের পাশে গোজা ঘোমটায় আবৃত মাথাটি নিশ্চল; চোখ তার বাষ্পের মতো ভাসে।
পানিতে ডুবতে থাকা মানুষের মতো মুখ তুলে আবার শরীর দীর্ঘ করে জমিলা, থাই পায় না কোথাও। শেষে সে রহীমাকে ডাকে,—বুবু!
রহীমা শোনে কি শোনে না! সে ফিরে তাকায়ও না, উত্তরও দেয় না। এ-দিকে ঢেউয়ের পর আরো ঢেউ আসে, উত্তাল উত্তঙ্গ ঢেউ। হু হু হু। আবার; হু হু হু। দুনিয়া যেন নিশ্বাস রুদ্ধ কোরে আছে, আকাশে যেন তারা নেই।
তারপর একটি পরে চীৎকার ওঠে। সঙ্গে সঙ্গে বিস্ময়কর দ্রুততায় আসতে থাকা পৰ্দাত প্রমাণ অজস্র ঢেউ ভেঙে ছত্ৰখান হয়ে যায়। মুহুর্তে কী যেন লণ্ডভণ্ড হয়ে যায়, মারাত্মক বন্যাকে যেন অবশেষে কারা রুখতে পারে না। এবার ভেসে যাবে জনমানব-ঘরবসতি, মানুষের আশা ভরসা।
বিদ্যুৎগতিতে জমিল উঠে দাঁড়ায়। ক্ষীণদেহে বৃদ্ধ বৃক্ষের মতো কঠিনভাবে দাঁড়িয়ে সে স্পষ্ট কণ্ঠে আবার ডাকে,—বুবু!
এবার রহীম। মুখ তুলে তাকায়। তার চওড়া দেহটি শান্ত দিনের নদীব মতো বিস্তু • আপ নিস্তরঙ্গ। উজ্জ্বল্পলৈ চোখ ঝলমল করছে বটে। কিন্তু তাও শান্ত, স্পষ্ট। সে-চোখের দিকে জমিলা তাকিয়ে থাকে কয়েক মুহুর্ত, কিন্তু অবশেষে কিছু বলে না। তারপর সে দ্রুতপায়ে হাঁটতে থাকে, উঠান পেরিয়ে বাইরের দিকে।