আচমকা ঘুম থেকে জেগে উঠে ঘরে ডাকাত পড়েছে ভেবে জমিলার চোখ ভীতবিহবল হয়ে ওঠে। প্ৰথমে। কিন্তু ক্রমশ শ্রবণশক্তি পরিষ্কার হতে থাকে এবং সঙ্গে সঙ্গে মজিদের রুষ্ট কথাগুলোর অর্থও পরিষ্কার হতে থাকে। কেন তাকে উঠিয়েছে সে-কথা এখন বুঝলেও জমিলা বসেই থাকে, ওঠার নামটি করে না।
সে ল্যাট মেরে বসেই থাকে। হঠাৎ তার মনে বিদ্রোহ জেগেছে। সে উঠবেও না, কিছু বলবেও না। কোনো কথাই সে বলে না। নামাজ যে পড়েছে, এ-কথাও না।
ক্ষণকালের জন্য মজিদ বুঝতে পারে না। কী করবে। মহব্বতনগরে তার দীর্ঘ রাজত্বকালে আপন হোক পর হােক কেউ তার হুকুম এমনভাবে জামান্য করেনি। কোনোদিন। আজ তার ঘরের এক রাত্তি বউ–যাকে সে সে-দিনমাত্র ঘরে এনেছে একটু নেশার ঝোঁক জেগেছিল বলে–সে কিনা তার কথায় কান না দিয়ে আমন নির্বিকারভাবে বসে আছে।
সত্যিই সে হতবুদ্ধি হয়ে যায়। অন্তরে যে-ক্ৰোধ দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠে সে-ক্ৰোধ ফেটে পড়বার পথ না পেয়ে অন্ধ সাপের মতো ঘুরতে থাকে, ফুসতে থাকে। তার চেহারা দেখে রহীমার বুক কেঁপে ওঠে ভয়ে। দীর্ঘ বারো বছরের মধ্যে স্বামীকে সে অনেকবার রাগতে দেখেছে, কিন্তু তার এমন চেহারা সে কখনো দেখেনি। কারণ সচরাচর সে যখন রাগে তখন তার রাগান্বিত মুখে কেমন একটা সমবেদনার, সমাজ ও ধর্মসংস্কারের সদিচ্ছার কোমল আভি ছড়িয়ে থাকে। আজ সেখানে নির্ভেজাল নিষ্ঠুর হিংস্ৰতা।
ভীতকণ্ঠে রহীমা বলে,–ওঠ বইন ওঠ, বহুত হইছে। নামাজ লইয়া কী রাগ করা যায়?
–রাগ? কিসের রাগ? মজিদ। আবার গর্জে ওঠে। এই বাড়িতে আহিলাদের জায়গা নাই। এই বাড়ি তার বাপের বাড়ি না।
তবু জমিলা ঠায় বসে থাকে। সে যেন মূর্তি।
অবশেষে আগ্নেয়গিরির মুখে ছিপি দিয়ে মজিদ সরে যায়। আসলে সে বুঝতে পারে না। এর পর কী করবে। হঠাৎ এমন এক প্ৰতিদ্বন্দ্বর সম্মুখীন হয় যে, সে বুঝে উঠতে পারে না তাকে কীভাবে দমন করতে হবে। এই ক্ষেত্রে, দীর্ঘকাল অন্দরে-বাইরে রাজত্ব করেও যে-সতর্কতার গুণটা হারায়নি, সে-সতর্কতাও সে অবলম্বন করে। ব্যাপারটা আদ্যোপান্ত সে ভেবে দেখতে চায়।
যাবার সময় একটি কথা বলে মজিদ,–ওর দিলে খোদার ভয় নেই। এইটা বড়ই আফসোসের কথা।
অর্থাৎ তার মনে পৰ্ব্বতপ্ৰমাণ খোদার ভীতি জাগাতে হবে। ব্যাপারটা আদ্যোপান্ত ভেবে দেখবার সময় সে-লাইনেই মজিদ ভাববে।
পরদিন সকালে কোরান পাঠ খতম করে মজিদ অন্দরে এসে দেখে, দরজার চৌকাঠের ওপর ক্ষুদ্র ঘোলাটে আয়নাটি বসিয়ে জমিলা অত্যন্ত মনোযোগ সহকারে সিথি কাটছে। তেল জব্বজবে পাট করা মাথাটি বাইরের কড়া রোদের ঝলক লেগে জ্বলজ্বল করে। মজিদ যখন পাশ কাটিয়ে ঘরে ঢোকে তখন জমিলা পিঠটা কেবল টান করে যাবার পথ করে দেয়, তাকায় না। তার দিকে।
এ-সময়ে মজিদ নিমের ডাল দিয়ে দাঁত মেছোয়াক করে। মেছোয়াক করতে করতে ঘরময় ঘোরে, উঠানে পায়চারি করে, পেছনে গাছগাছলার দিকে চেয়ে কী দেখে। দীর্ঘ সময় নিয়ে সযত্নে মেছোয়াক করে–দাঁতের আশে-পাশে, ওপরে-নীচে। ঘষতে-ঘষতে ঠোঁটের পাশে ফেনার মতো থুথু জমে ওঠে। মেছোয়াকের পালা শেষ হলে গামছাটা নিয়ে পুকুরে গিয়ে দেহ রগড়ে গোসল কোরে আসে।
একটু পরে একটা নিমের ডাল দাঁতে কামড়ে ধরে জমিলার দেহ ঘে যে আবার বেরিয়ে আসে মজিদ। আড়চোখে একবার তাকায় বউ-এর পানে। মনে হয়, ঘোলাটে আয়নায় নিজেরই প্ৰতিচ্ছবি দেখে চকচক করে মেয়েটির চোখ। সে-চোখে বিন্দুমাত্র খোদার ভয় নেই।–মানুষের ভয় তো দূরের কথা।
মেছোয়াক করতে করতে উঠানে চক্কর খায় মজিদ। এক সময়ে সশব্দে থুথু ফেলে সে দরজার কাছে এসে দাঁড়ায়। দরজায় পাকা সিঁড়ি নেই। পুকুর ঘাটে যেমন থাক থাক কোরে কাটা নারকেল গাছের গুড়ি থাকে, তেমনি একটা গুড়ি বসানো। তারই নিচের ধাপে পা রেখে মজিদ আবার থুথু ফেলে, তারপর বলে,—রূপ দিয়া কী হইবো? মাইনষের রূপ ক-দিনের? ক-দিনেরই বা জীবন তার?
ক্ষিপ্ৰগতিতে জমিলা স্বামীর পানে তাকায়। শত্রুর আভাস পাওয়া হরিণের চোখের মতোই সতর্ক হয়ে ওঠে তার চোখ।
মজিদ বলে চলে,—তোমার বাপ-মা দেখি বড় জাহেল কিছিমের মানুষ। তোমারে কিছু শিক্ষা দেয় নাই। অবশ্য তার জন্যে হাশরের দিনে তারাই জবাবদিহি দিবো। তোমার দোষ কী?
জমিলা শোনে, কিছু বলে না। মজিদ কয়েক মুহুর্ত অপেক্ষা কোরে বলে,–কাইল যে কামটি করছ, তা কী শক্ত গুণার কাম জানো নি, ক্যামনে করলা কামটা? খোদারে কী ডরাও না, দোজখের আঁগরে কী ডরাও না?
জমিলা পূর্ববৎ নীরব। কেবল ধীরে ধীরে কাঠের মতো শক্ত হয়ে ওঠে তার মুখটা।
–তাছাড়া, এই কথা সর্বদা খেয়াল রাখিও যে, যার-তার ঘরে আস নাই তুমি! এই ঘর মাজার পাকের ছায়ায় শীতল, এইখানে তাঁনার রূহ-এর দোয়া মানুষের শান্তি দেয়, সুখ দেয়। তাঁনার দিলে গোসা আসে এমন কাম কোনো দিন করিও না।
তারপর আর একবার সশব্দে থুথু ফেলে মজিদ পুকুর ঘাটের দিকে রওনা হয়।
জমিলা তেমনি বসে থাকে। ভঙ্গিটা তেমনি সতর্ক,কান খাড়া কোরে রাখা সশঙ্কিত হরিণের মতো। তারপর হঠাৎ একটা কথা সে বোঝে। কঁচা গোস্তে মুখ দিতে গিয়ে খট কোরে একটা আওয়াজ শুনে ইদুর যা বোঝে, হয়তো তেমনি কিছু একটা বোঝে সে। সে যেন খাচায় ধরা পড়েছে।
তারপর এক অদ্ভুত কাণ্ড ঘটে। দপ করে জমিলার চোখ জ্বলে ওঠে। সঙ্গে সঙ্গে তার ঠোঁট কেঁপে ওঠে, নাসারন্ধ বিস্ফারিত হয়, দাউ দাউ করা শিখার মতো সে দীর্ঘ হয়ে ওঠে।