হঠাৎ মজিদ গর্জন করে ওঠে। বলে, আমার দরজার থিক। উঠবার কও তারে। ও কী ঘরে বালা আনবার চায় নাকি? চায় নাকি আমার সংসার উচ্ছন্নে যাক, মড়ক লাগুক ঘরে?
গর্জন শুনে রহীমার বুক পর্যন্ত কেঁপে ওঠে। জমিলাও এবার নড়ে। হঠাৎ মুখ ফিরিয়ে কেমন অবসন্ন দৃষ্টিতে তাকায় এদিকে, তারপর হঠাৎ উঠে সিড়ি দিয়ে নেমে গোয়াল ঘরের দিকে চলে যায়।
সে-রাতে দূরে ডোমপাড়ায় কিসের উৎসব। সেই সন্ধ্যা থেকে একটানা ভেঁাতা উত্তেজনায় ঢোলক বেজে চলেছে। বিছানায় শুয়ে জমিলা এমন আল গাছে নিঃশব্দ হয়ে থাকে, যেন সে বিচিত্ৰ ঢোলকের আওয়াজ শোনে কান পেতে। মজিদও অনেকক্ষণ নিঃশব্দ হয়ে পড়ে থাকে। একবার ভাবে, তাকে জিজ্ঞাসা করে কী হয়েছে তার, কিন্তু একটা কুল-কিনারাহীন অর্থই প্রশ্নের মধ্যে নিমজ্জিত মনের আভাস পেয়ে মজিদের ভেতরটা এখনো খিটখিটে হযে আছে। প্রশ্ন করলে কী একটা অতল তার প্রমাণ পাবে–এই ভয় মনে। মাজারের সান্নিধ্যে বসবাস করার ফলে মজিদ এই দীর্ঘ এক যুগকাল সময়েব মধ্যে বহু ভগ্ন, নির্মমভাবে আঘাত-পাওয়া হৃদয়ের পরিচয় পেয়েছে। তাই আজ সকালে ঐ সাতকুল খাওয়া শনের মতো চুল মাথায় বুড়াটার ছুরি বা মতো ধারাল তীক্ষ্ম বিলাপ মজিদের মনকে বিন্দুমাত্র বিচলিত করতে পারেনি।। কিন্তু সে-বিলাপ শোনার পর থেকেই জমিলা যেন কেমন হয়ে গেছে। কেন?
মনে মনে ক্ৰোধে বিড়বিড় কোরে মজিদ বলে, যেন তার ভাতার মরছে!
ডোমপাড়ায় অবিশ্রান্ত ঢোলক বেজে চলে; পৃথিবীর মাটিতে অন্ধকারের তলানি গাঢ় হতে গাঢ়তর হয়। মজিদের ঘুম আসে না; ঘুমের আগে জমিলার গায়ে-পিঠে হাত বুলিয়ে খানিক আদর করা প্ৰায় তার অভ্যাস হয়ে দাড়ালেও আজ তার দিকে তাকায় না পর্যন্ত। হয়তো এই মুহুর্তে দুনিয়ার নির্মমতার মধ্যে হঠাৎ নিঃসঙ্গ হয়ে ওঠা জমিলার অন্তর একটু আদরের জন্য, একটু স্নেহ-কোমল সান্থনার জন্য বা মিষ্টি মধুর আশার কথার জন্য খা-খ্যা করে, কিন্তু মজিদের আজ আব্দর শুকিয়ে আছে। তার সে-শুষ্ক হৃদয় ঢোলকের একটানা আওয়াজের নিরন্তর খোচায় ধিধিক-ধিকি কোরে জ্বলে, মনের অন্ধকারে স্ফুলিঙ্গর ছটা জাগে। সে ভাবে, নেশার লোভে কাকে সে ঘরে আনল? যার কচি কোমল লতার মতো হাল্কা দেহ দেখে আর এক ফালি চাঁদের মতো ছোট মুখ দেখে তার এত ভালো লেগেছিল— তার এ কী পরিচয় পাচ্ছে ধীরে ধীরে?
তারপর কখন মজিদ ঘুমিয়ে পড়েছিল। মধ্যরাতে ঢোলকের আওয়াজ থামলে হঠাৎ নিরবচ্ছিন্ন নীরবতা ভারী হয়ে এল। তারই ভারিত্বে হয়তো চিন্তাক্ষত মজিদের অস্পষ্ট ঘুম ছুটে গেলো। ঘুম ভাঙলেই তার একবার আল্লাহু আকবর বলার অভ্যাস। তাই অভ্যাসবশত সোঁ-শব্দ দুটো উচ্চারণ করে পাশে ফিরে তাকিয়ে দেখে জমিলা নেই। কয়েক মুহূর্ত সে কিছু বুঝল না, তারপর ধাঁ কোরে উঠে বসল। তারপর নিজেকে অপেক্ষাকৃত সংযত করে আকম্পিত হাতে দেশলাই জালিয়ে কুপিটা ধরাল।
পাশের বারান্দার মতো ঘরটায় রহীমা শোয়। সেখানেই রহীমার প্ৰশস্ত বুকে মুখ গুঁজে জমিলা অঘোরে ঘুমাচ্ছে। কুপিটার লালচে আলো মুখে পড়তেই তার ঠোঁটটা একটু নড়ে উঠল–যেন মাই খেতে খেতে ভুল থেমে গিয়েছিল, আলো দেখে হঠাৎ স্মরণ হলো সে-কথা।
পরদিন জমিলার মুখের অন্ধকারটা কেটে যায়। কিন্তু মজিদের কাটে না। সে সারাদিন ভাবে। রাতে রহীমা যখন গোয়াল ঘরে গামলাতে হাত ডুবিয়ে নুনপানি মেশানো ভুষি গোলায় তখন বাইরের ঘর থেকে ফিরবার মুখে মজিদ সেখানে এসে দাঁড়ায়। রহীমার মুখ ঘামে চকচক করে আর ভন ভন কোরে মশায় কাটে তার সারা দেহ। পায়ের আওয়াজে চমকে উঠে রহীমা দেখে, মজিদ। তারপর আবার মুখ নিচু করে ভুষি গোলায়।
মজিদ একবার কাশে। তারপর বলে,–জমিলা কই?
–ঘুমাইছে বোধ হয়।
জমিলার সন্ধ্যা হতে না হতেই ঘুমোবার অভ্যাস। মজিদ বলা কওয়াতে সে নামাজ পড়তে শুরু করেছে, কিন্তু প্ৰায়ই এশার নামাজ পড়া তার হয়ে ওঠে না, এই নিদারুণ ঘুমের জন্য। নামাজ তো দূরের কথা, খাওয়াই হয়ে ওঠে না। যে-রাতে অভুক্ত থাকে তার পরদিন অতি ভোরে উঠে ঢাকাঢোকা যা বাসী খাবার পায় তাই খায় গরগর করে।
মজিদ এবার চাপা গলায় গর্জে ওঠে,–ঘুমাইছে? তুমি কাম করবা, হে লালবিবির মতো খাটে চইড়া ঘুমাইবো বুঝি? ক্যান, এত ক্যান? থেমে আবার বলে, নামাজ পড়ছে নি?
নামাজ সে আজ পড়েছে। মগরেবের নামাজের পরেই ঢুলতে শুরু করেছিল, তবু টান হয়ে বসেছিল আধা ঘণ্টার মতো। তারপর কোনো প্রকারে এশার নামাজ সেরেই সোজা বিছানায় গিয়ে ঘুম দিয়েছে। কিন্তু তখন রহীমা পেছনে ছাপড়া দেওয়া ঘরটিতে বসে বান্না কবছিল বলে
–কী জানি, বোধ হয় পড়েছে।
–বোধ হয় বুধ হয় জানি না। খোদার কামে ঐসব ফাইজলামি চলে না। যাও, গিয়া তারে ঘুম থিক তোল, তারপর নামাজ পড়বার কও।
রহীমা নিরুত্তরে ভুষি গোলানো শেষ করে। গাইটা নাসারন্ধ ডুবিয়ে র্সো-র্সে আওয়াজ করে। ভুষি খেতে শুরু করে, কুপির আলোয় চকচক করে তার মস্ত কালো চোখজোড়া। সে-চোখের পানে কয়েক মুহুর্ত তাকিয়ে থেকে রহীমা ঘর থেকে বেরিয়ে যায়, পেছনে পেছনে যায় মজিদ।
হাত ধুয়ে এসে ঠাণ্ড সে-হাত দিয়ে জমিলার দেহ স্পর্শ করে রহীমা, যখন ধীরে ধীরে ডাকে তখনো মজিদ পেছনে দাঁড়িয়ে থাকে, একটা অধীরতায় তার চোখ চকচক করে। কিন্তু সে অধীর হলে কী হবে, জমিলার ঘুম কাঠের মতো। সে-ঘুম ভঙে না। রহীমার গলা চড়ে, ধাক্কানি জোরাল হয়, কিন্তু সে যেন মরে আছে। এই সময়ে এক কাণ্ড করে মজিদ। হঠাৎ এগিয়ে এসে একহাত দিয়ে রহীমাকে সরিয়ে একটানে জমিলাকে উঠিয়ে বসিয়ে দেয়। তার শক্ত মুঠির পোষণে মেয়েটির কাজার কচি হাড় হয়তো মড়মড় করে ওঠে।