আপন থেকে হাসি যখন থামে। তখন জমিলা বলে,–একটা মজার কথা মনে পড়ল বইলাই হাসলাম বুবু।
হাসি থেমেছে দেখে রহীমা নিশ্চিন্ত হয়। তাই এবার সহজ গলায় প্ৰশ্ন কবে,–কী কথা বইন?
–কমু? বলে চোখ তুলে তাকায় জমিলা। সে-চোখ কৌতুকে নাচে।
–কও না!
বলবার আগে দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে সে কী যেন ভাবে। তারপর বলে,
–তানি যখন আমারে বিয়া করবার যায় তখন খোদেজা বুবু বেড়ার ফাঁক দিয়া তানারে দেখাইছিল।
-কারে দেখাইছিল?
–আমারে। তয় দেইখা আমি কই, দ্যুত, তুমি আমার লগে মস্কার কর খোদেজা বুবু। কারণ কী আমি ভাবলাম, তানি বুঝি দুলার বাপ। আর–হঠাৎ আবার হাসির একটা দমক আসে, তবু নিজেকে সংযত কোরে সে বলে–আর, এইখানে তোমারে দেইখা ভাবলাম তুমি বুঝি শাশুড়ী।
কথা শেষ করেছে কী আমনি জমিলা আবার হাসিতে ফেটে পড়ল। কিন্তু সে-হাসি থামতে দেরী হলো না। রহীমার হঠাৎ কেমন গম্ভীর হয়ে ওঠা মুখের দিকে তাকিয়ে সে আচমকা থেমে গেলো।
সারা দুপুর পাটি বোনে, কেউ কোনো কথা কয় না। নীরবতার মধ্যে এক সময়ে জমিলার চোখ ছলছল কোরে ওঠে, কিসের একটা নিদারুণ অভিমান গলা পর্যন্ত উঠে। ভারী হয়ে থাকে। রহীমার অলক্ষ্যে ছাপিয়ে ওঠা অশ্রুর সঙ্গে কতক্ষণ লড়াই কোরে জমিলা তারপর কেঁদে ফেলে।
হাসি শুনে রহীম। যেমন চমকে উঠেছিল। তেমনি চমকে ওঠে তার কান্না শুনে। বিস্মিত হয়ে কতক্ষণ তাকিয়ে থাকে জমিলার পানে। জমিলা কাঁদে আর পাটি বোনে, থেকে থেকে মাথা ঝোঁকে চোখ-নাক মেছে।
রহীমা আস্তে বলে,–কাঁদো ক্যান বইন?
জমিলা কিছুই বলে না। পশলাটি কেটে গেলে সে চোখ তুলে তাকায় রহীমার পানে, তারপর হাসে। হেসে সে একটি মিথ্যা কথা বলে।
বলে যে, বাড়ির জন্যে তার প্রাণ জ্বলে। সেখানে একটা নুলা ভাইকে ফেলে এসেছে, তার জন্যে মনটা কাঁদে। বলে না যে, রহীমাকে হঠাৎ গম্ভীর হতে দেখে বুকে অভিমান ঠেলে এসেছিল এবং একবার অভিমান ঠেলে এলে কান্নাটা কী কোরে আসে সব সময়ে বোঝা যায় না। রহীমা উত্তরে হঠাৎ তাকে বুকে টেনে নেয়, কপালে আস্তে চুমা খায়।
জমিলাই কিন্তু দুদিনের মধ্যে ভাবিয়ে তোলে মজিদকে। মেয়েটি যেন কেমন! তার মনের হদিশ পাওয়া যায় না। কখন তাতে মেঘ আসে, কখন উজ্জল আলোয় ঝলমল করে–পূর্বাহ্নে তার কোনো ইঙ্গিত পাওয়া দুষ্কর। তার মুখ খুলেছে বটে কিন্তু তা রহীমার কাছেই। মজিদের সঙ্গে এখনো সে দুটি কথা মুখ তুলে কয় না। কাজেই তাকে ভালোভাবে জানিবারও উপায় নেই।
একদিন সকালে কোথেকে মাথায় শনের মতো চুলওয়াল খ্যাংটাঙ্ক বুড়ী মাজারে এসে তীক্ষ্ম আর্তনাদ শুরু করে দিলো। কী তার বিলাপ, কী ধারাল তার অভিযোগ। তার সাতকুলে কেউ নেই, এখন নাকি তার চোখের মণি একমাত্র ছেলে যাদুও মরেছে। তাই সে মাজারে এসেছে খোদার অন্যায়ের বিরুদ্ধে নালিশ করতে।
তার তীক্ষ্ম বিলাপে সকালটা যেন কাঁচের মতো ভেঙে খান-খান হয়ে গেলো। মজিদ তাকে অনেক বোঝাবার চেষ্টা করে, কিন্তু ওর বিলাপ শেষ হয় না, গলার তীক্ষ্ণতা কিছুমাত্র কোমল হয় না। উত্তরে এবার সে কোমরে গোজ আনা পাঁচেক পয়সা বের কোরে মজিদের দিকে ছুঁড়ে দিয়ে বলে,–সব দিলাম। আমি, সব দিলাম। পোলাটার এইবার জান ফিরাইয়া দেন।
মজিদ আরো বোঝায়। তাকে–ছেলে মরেছে, তার জন্যে শোক করা উচিত নয়। খোদার যে বেশী পেয়ারের হয় সে আরো জলদি দুনিয়া থেকে প্ৰস্থান করে। এবার তার উচিত মৃত ছেলের রাহ-এর জন্যে দোয় করা; সে যেন বেহেস্তে স্থান পায়, তার গুণাহ যেন মাফ হয়ে যায়–তার জন্যে দোয় করা।
কিন্তু এ-সব ভালো নছিহতে কান নেই বুড়ীর; শোক আগুন হয়ে জড়িয়ে ধরেছে তাকে, তাতে দাউ-দাউ কোরে পুড়ে মরছে। মজিদ আর কী করে। পয়সাটা কুড়িয়ে নিয়ে চলে আসে। অন্দরে আসতে, দেখে বেড়ার কাছে দাঁড়িয়ে আছে জমিলা, পাথরের মতো মুখ্য-চোখ। মজিদ থমকে দাঁড়িয়ে কতক্ষণ তার পানে চেয়ে থাকে, কিন্তু তার হুঁশ নেই।
সেই থেকে মেয়েটির কী যেন হয়ে গেলো। দুপুরের আগে মজিদকে নিকটে কোনো এক স্থানে যেতে হয়েছিল, ফিরে এসে দেখে দরজার চৌকাঠে হেলান দিয়ে গালে হাত চেপে জমিলা মূর্তির মতো বসে আছে, ঝুরে আসা চোখে আশপাশের দিশ নাই।
রহীমা বদনা কোরে পানি আনে, খড়ম জোড়া রাখে পায়ের কাছে। মুখ ধুতে-ধুতে সজোরে গলা সাফ করে মজিদ, তারপর আবার আড়চোখে চেয়ে দেখে জমিলাকে। জমিলার নড়াচড় নেই। তার চোখ যেন পৃথিবীর দুঃখ বেদনার অর্থহীনতায় হারিয়ে গেছে।
খাওয়া-দাওয়া শেষ হলে মজিদ দরজার কাছাকাছি একটা পিাড়িতে এসে বসে। রহীমার হাত থেকে হুকটা নিয়ে প্রশ্ন করে,—ওইটার হইছে কী?
রহীমা একবার তাকায় জমিলার পানে। তারপর আঁচল দিয়ে গালের ঘাম মুছে আস্তে বলে,–মন খারাপ করছে।
ঘন ঘন বার কয়েক হুঁকায় টান দিয়ে মজিদ আবার প্রশ্ন করে,–কিন্তু–ক্যান খারাপ করছে?
রহীমা সে-কথার জবাব দেয় না। হঠাৎ জমিলার দিকে তাকিয়ে ধমকে ওঠে–ওঠ ছেমড়ি, চৌকাঠে ঐ রকম কইরা বসে না।
মজিদ হুক টানে আর নীলাভ ধোয়ার হাল্কা পর্দা ভেদ করে তাকায় জমিলার পানে। জমিলা যখন নড়বার কোনো লক্ষণ দেখায় না। তখন মজিদের মাথায় ধীরে ধীরে একটা চিনচিনে রাগ চড়তে থাকে। মন খারাপ হয়েছে? সে যদি হতো নানারকম দায়িত্ব ও জ্বালা-যন্ত্রণার মধ্যে দিয়ে দিন কাটানো মস্ত সংসারের কত্রী–তবে না হয় বুঝত মন খারাপের অর্থ। কিন্তু বিবাহিতা একরাত্তি মেয়ের আবার ওটা কী ঢঙ? তাছাড়া মানুষের মন খারাপ হয় এবং তাই নিয়ে ঘর সংসারের কাজ করে, কথা কয়, হাঁটে-চলে। জমিলা যেন ঠাটাপড়া মানুষের মতো হয়ে গেছে।