এভাবেই মজিদের প্রবেশ হলো মহব্বতনগর গ্রামে। প্রবেশটি নাটকীয় হয়েছে সন্দেহ নেই, কিন্তু গ্রামের লোকেরা নাটকের পক্ষপাতী। সরাসরি মতিগঞ্জের সড়ক দিয়ে যে গ্রামে এসে ঢুকবে তার চেয়ে বেশী পছন্দ হবে তাকে, যে বিলটার বড় অশ্বত্থ গাছ থেকে নেমে আসবে। মজিদের আগমনটা তেমনি চমকপ্ৰদ।। চমকপ্ৰদ এই জন্যে যে, তার আগমন মুহুর্তে সমগ্ৰ গ্ৰামকে চমকে দেয়। শুধু তাই নয়, গ্রামবাসীদের নিবুদ্ধিতা সম্পর্কে তাদের সচেতন করে দেয়, অনুশোচনায় জর্জরিত করে দেয় তাদের অন্তর।
শীর্ণ লোকটি চীৎকার করে গালাগাল করে লোকদের। খালেক ব্যাপারী ও মাতব্বর রেহান আলী ছিল। জোয়ান মদ্দ কালু মতি, তারাও ছিল। কিন্তু লজ্জায় তাদের মাথা হেঁট। নবাগত লোকটির কোটরাগত চোখে আগুন।
–আপনারা জাহেল, বেএলেম, আনপাড়হ। মোদচ্ছের পীরের মাজারকে আপনারা এমন করি ফেলি রাখছেন?
গ্ৰাম থেকে একটু বাইরে একটা বৃহৎ বাঁশঝাড়। মোটাসোটা হলদে তার গুঁড়ি। সেই বাঁশঝাড়ের ক-গজ ওধারে একটা পরিত্যক্ত পুকুরের পাশে ঘন সন্নিবিষ্ট হয়ে আছে গাছপালা। যেন একদিন কার বাগান ছিল সেখানে। তারই একাধারে টালখাওয়া ভাঙা এক প্ৰাচীন কবর। ছোট ছোট ইটগুলো বিবৰ্ণ শ্যাওলায় সবুজ, যুগযুগের হাওয়ায় কালচে। ভেতরে সুড়ঙ্গের মতো। শেয়ালের বাসা হয়তো। ওরা কী করে জানবে যে, ওটা মোদাচ্ছের পীরের মাজার?
সভায় অশীতিপর বৃদ্ধ সলোমানের বাপিও ছিল। হাঁপানির রোগী। সে দম খিঁচে লজ্জায় নত করে রাখে চোখ।
-আমি ছিলাম গারো পাহাড়ে, মধুপুর গড় থেকে তিন দিনের পথ।–মজিদ বলে। বলে যে, সেখানে সুখে শান্তিতেই ছিল। গোলাভরা ধান, গরু-ছাগল। তবে সেখানকার মানুষরা কিন্তু অশিক্ষিত বর্বর। তাদের মধ্যে কিঞ্চিৎ খোদার আলো ছড়াবার জন্যেই আমন বিদেশ বিভু-এ সে বসবাস করছিল। তারা বর্বর হলে কী হবে, দিল তাদের সাচ্চা, খাঁটি সোনার মতো। খোদা-রসুলের ডাক একবার দিলে পৌঁছে দিতে পারলে তারা বেচাইন হয়ে যায়। তাছাড়া তাদের খাতির-যত্ন ও স্নেহ-মমতার মধ্যে বেশ দিন কাটছিল; কিন্তু সে একদিন স্বপ্ন দেখে। সে-স্বপ্নই তাকে নিয়ে এসেছে এত দূরে। মধুপুর গড় থেকে তিন দিনের পথ সে দুৰ্গম অঞ্চলে মজিদ যে বাড়ি গড়ে তুলেছিল তা নিমেষের মধ্যে ভেঙে ছুটে চলে এসেছে।
লোকেরা ইতিমধ্যে বার-কয়েক শুনেছে সে-কথা, তবু আবার উৎকর্ণ হয়ে ওঠে।
– উনি একদিন স্বপ্নে ডাকি বললেন…
বলতে বলতে মজিদের কোটরগত ক্ষুদ্র চোখ দুটো পানিতে ছাপিয়ে ওঠে।
গ্রামের লোকগুলি ইদানীং অবস্থাপন্ন হয়ে উঠেছে। জোতজমি করেছে, বাড়িঘর করে গরু ছাগল আর মেয়েমানুষ পুষে চড়াই-উতরাই ভাব ছেড়ে ধীরস্থির হয়ে উঠেছে, মুখে চিকনাই হয়েছে। কিন্তু খোদার দিকে তাদের নজর কম। এখানে ধানক্ষেতে হাওয়া গান তোলে বটে। কিন্তু মুসল্লীদের গলা আকাশে ভাসে না। গ্রামের প্রান্তে সেই জঙ্গলের মধ্যে কবরের পাশে দাঁড়িয়ে বুকে ঝোলানো তামার দাঁত-খিলাল দিয়ে দাঁতের গহবর খোঁচাতে খোঁচাতে মজিদ সেদিন সে-কথা স্পষ্ট বুঝেছিল। সঙ্গে সঙ্গে এ-কথাও বুঝেছিল যে, দুনিয়ায় সচ্ছলভাবে দু’বেল খেয়ে বঁচবার জন্যে যে-খেলা খেলতে যাচ্ছে সে-খেলা সাংঘাতিক। মনে সন্দেহ ছিল, ভয়ও ছিল। কিন্তু জমায়েতের অধোবদন চেহারা দেখে পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল অন্তর! হঠাপানি-রোগগ্ৰস্ত অশীতিপর বুদ্ধের চোখের পানে চেয়েও তাতে লজ্জা ছাড়া কিছু দেখেনি।
জঙ্গল সাফ হয়ে গেলে। ইট-সুরকি নিয়ে সেই প্ৰাচীন কবর সদ্যমৃত কোনো মানুষের কবরের মতো নোতুন দেহ ধারণ করল। ঝালরওয়ালা সালু দ্বারা আবৃত হলো মাছের পিঠের মতো সে কবর। আগরবাতি গন্ধ ছড়াতে লাগল, মোমবাতি জ্বলতে লাগল। রাতদিন। গাছপালায় ঢাকা স্থানটি আগে স্যাঁতসেঁতে ছিল, এখন রোদ পড়ে খটখাটে হয়ে উঠল। হাওয়ারও ভাপসা গন্ধ খড়ের মতে শুষ্ক হয়ে উঠল।
এ-গ্ৰাম সে-গ্রাম থেকে লোকেরা আসতে লাগল। তাদের মৰ্মদ্ভদ কান্না, অশ্রুসজল কৃতজ্ঞতা, আশার কথা, ব্যর্থতার কথা সালুতে আবৃত মাছের পিঠের মতো অজ্ঞাত ব্যক্তির সেই কবরের কোলে ব্যক্ত হতে লাগল দিনের পর দিন। তার সঙ্গে পয়সা–ঝকঝকে পয়সা, ঘষা পয়সা, সিকি-দুয়ানি-আধুলি, সাচ্চ টাকা, নকল টাকা ছড়াছড়ি যেতে লাগল।
ক্ৰমে ক্ৰমে মজিদের ঘরবাড়ি উঠল। বাহির ঘর, অন্দর ঘর, গোয়াল ঘর, আওলাঘর। জমি হলো, গৃহস্থালী হলো। নিরাকপড়া শ্রাবণের সেই হাওয়া-শূন্য স্তব্ধ দিনে তাঁর জীবনের যে নোতুন অধ্যায় শুরু হয়েছিল, মাছের পিঠের মতো সালু কাপডে আবৃত নশ্বর জীবনের প্রতীকটির পাশে সে জীবন পদে পদে এগিয়ে চলল। হয়তো সামনের দিকে, হয়তো কোথাও নয়। সে-কথা ভেবে দেখবার লোক সে নয়। বতোরঙ্গ দিনে মাগর-মগরা ধান আসে ঘরে, তাই যথেষ্ট। তথাকথিত মাজারেব পানে চেয়ে কাচিৎ কখনো সে যে ভাবিত না তা নয়। কিন্তু তারও যে বঁচবার অধিকার আছে সেই কথাটাই সে সাময়িক চিন্তার মধ্যে প্ৰধান হয়ে ওঠে। তাছাড়া গারো পাহাড়ের শ্রমক্লান্ত হাড় বোবকরা দিনের কথা স্মরণ হলে সে শিউরে ওঠে। ভাবে, খোদাব বান্দা সে নির্বোধ ও জীবনের জন্যে অন্ধ। তার ভুলভ্রান্তি তিনি মাফ কবে দেবেন। তাঁর করুণা অপার, সীমাহীন।
একদিন মজিদ বিয়েও করে। অনেকদিন থেকে আলি-বালি একটি চওড়া বেওয়া মেয়েকে দেখছিল। দেহে যৌবন যেন ব্যাপ্ত হয়ে ছড়িয়ে আছে, বিশাল তার রূপ। দূর থেকে আবছা আবছা তার প্রশস্ত দেহ দেখে শীর্ণ মজিদ জ্বলে উঠেছিল।