পরদিন সকালে মজিদ যখন কোরান শরীফ পড়ে তখন তার অশা? আত্মা সূক্ষ্ম হয়ে ওঠে মিহি চিকণ কণ্ঠের ঢালা সুরে। পড়তে পড়তে তার ঠোঁট পিচ্ছিল ও পাতলা হয়ে ওঠে, চোখে আসে এলোমেলো হাওয়ার মতো অস্থিরতা।
বেলা চড়লে তার কোরান পাঠ খতম হয়। উঠানে সে যখন বেরিয়ে আসে তখনো কিন্তু তার ঠোঁট বিড়বিড় করে–তাতে যেন কোরান পাঠের রেশ লেগে আছে।
উঠানের কোণে অ।ওলাঘরের নীচু চালের ওপর রহীমা কদুর বিচি শুকাবার জন্যে বিড়িয়ে দিচ্ছিল। সে পেছন ফিরে আছে বলে মজিদ আড়াচোখে চেয়ে চেয়ে তাকে দেখে কতক্ষণ। যেন অপরিচিত কাউকে দেখে লুকিয়ে লুকিয়ে। কিন্তু চোখে আগুন জ্বলে না।
রাতে মজিদ রহীমাকে বলে,–বিবি, একটা কথা।
শুনবার জন্যে রহীমা পা টেপা বন্ধ করে। তারপর মুখটা তেরছাভাবে ঘুরিয়ে তাকায় স্বামীর পানে।
–বিবি,আমাগো বাড়িটা বড়ই নিরানন্দ। তোমার একটা সাখী আনুম? সাখী মানে সতীন। সে-কথা বুঝতে রহীমার এক মুহূর্ত দেরী হয় না। এবং পলকের মধ্যে কথাটা বোঝে বলেই সহসা কোনো উত্তর আসে না মুখে।
রাহীমাকে নিরুত্তর দেখে মজিদ প্রশ্ন করে,–কী কও?
–আপনে যেমুন বোঝেন।
তারপর আর কথা হয় না। রহীমা আবার পা টিপতে থাকে বটে কিন্তু থেকে থেকে তার হাত থেমে যায়। সমস্ত জীবনের নিস্ফলতা ও অন্তঃসারশূন্যতা এই মুহূর্তে তার কাছে হঠাৎ মন্ত বড় হয়ে ওঠে। কিন্তু বলবার তার কিছুই নেই।
০৭. মজিদের দ্বিতীয় বিয়ে
জ্যৈষ্ঠের কড়া রোদে মাঠ। ফাটছে আর লোকদের দেহ দানা-দানা হয়ে গেছে। ঘামচিতে, এমন সময় মসজিদের কাজ শেষ হয়। এবং তার কিছু দিনের মধ্যেই মজিদের দ্বিতীয় বিয়েও সম্পন্ন হয় অনাড়ম্বর দ্রুততায়। ঢাকঢোল বাজে না, খানাপিনী মেহমান অতিথ-এর হৈহুলস্থূল হয় না, অত্যন্ত সহজে ব্যাপারটা চুকে যায়।
বউ হয়ে যে মেয়েটি ঘরে আসে যে যেন ঠিক বেড়ালছানা। বিয়ের আগে মজিদ ব্যাপারীকে সংগোপনে বলেছিল যে, ঘরে এমন একটি বউ আনবে যে খোদাকে ভয় করবে। কিন্তু তাকে দেখে মনে হয়, সে খোদাকে কেন সব কিছুকেই ভয় করবে, মানুষ হাসিমুখে আদর করতে গেলেও ভয়ে কেঁপে সারা হয়ে যাবে।
নোতুন, বউ-এর নাম জমিলা। জমিলাকে পেযে রহীমার মনে শাশুড়ির ভাব জাগে। স্নেহ-কোমল চোখে সাবক্ষণ তাকে চেয়ে চেয়ে দেখে, আর যাত্র দেখে তেওঁ ভােলা লাগে তাকে। আদর-যত্নে করে খাওয়ায় দাওয়ায় তাকে। ওদিকে মজিদ ঘনঘন দাঁড়িতে হাত বুলায়, আর তার আশপাশ আ৷ তারের গন্ধে ভুর ভুর করে।
এক সময় গলায় পুলক জাগিয়ে মজিদ প্রশ্ন করে,—হে নামাজ জানে নি?
রহীমা জমিলার সঙ্গে একবার গোপনে আলাপ করে নেয়। তারপর গলা চড়িয়ে বলে,–জানে।
–জানলে পড়ে না। ক্যান?
জমিলার সঙ্গে আলাপ না করেই রহীমা সরাসরি উত্তর দেয়,–পড়বে আর কী ধীরে-সুস্থে।
আড়লে রহীমাকে মজিদ প্রশ্ন করে,—তোমার হে মানসন্মান করে নি?
—করে না? খুব করে। একরাত্তি মাইয়া, কিন্তু বড় ভালা। চোখ পর্যন্ত তোলে না।
তারা দুজনেই কিন্তু ভুল করে। কারণ দিন কয়েকের মধ্যে জমিলার আসল চরিত্ৰ প্ৰকাশ পেতে থাকে। প্ৰথমে সে ঘোমটা খোলে তারপর মুখ আড়াল করে হাসতে শুরু করে। অবশেষে ধীরে ধীরে তার মুখে কথা ফুটতে থাকে। এবং একবার যখন ফোটে তখন দেখা যায় যে, অনেক কথাই সে জানে ও বলতে পারে–এতদিন কেবল তা ঘোমটার তলে ঢেকে রেখেছিল।
একদিন বাইরের ঘর থেকে মজিদ হঠাৎ শোনে সোনালী মিহিসুন্দর হাসির ঝঙ্কার। শুনে মজিদ চমকিত হয়। দীর্ঘ জীবনের মধ্যে এমন হাসি সে কখনো শোনেনি। রহীমা জোরে হাসে না। সালু আবৃত মাজারের আশেপাশে যারা আসে তারাও কোনোদিন হাসে না। অনেক সময় কান্নার রেল ওঠে, কত জীবনের দুঃখবেদনা বরফ-গলা নদীর মতো হুহু করে ভেসে আসে আর বুকফাটা দীর্ঘশ্বাসের দমক। হাওয়া জাগে, কিন্তু এখানে হাসির ঝঙ্কার ওঠে না কখনো! এখানকার কথা ছেডে দিলেও, আগেই-ব৷ মজিদ কবে এমন হাসি শুনন্তে। জীৰ্ণ গোয়’লঘরের মতে। মক্তবে খিটখিঢ়ে মেজাজের মৌলবীর সামনে প্রাণভয়ে তার স্বাবে আমিসিপির পাড়া হতে শুরু করে অন্ন সংস্থানের জন্য তিক্তি তম সংগ্ৰ মের দিনগুলির মধ্যে কোথাও হাসির লেশমাত্ৰ আভাস নেই। তাই কয়েক মুহুর্ত বিমুগ্ধ মানুষের মতো মজিদ স্তব্ধ হয়ে থাকে। তারপর সামনের লোকটির পানে তাকিয়ে হঠাৎ সে শক্ত হয়ে যায়। মুখের পেশী টান হয়ে ওঠে, আর কুঁচকে যায় ভুরু।
পরে ভেতরে এসে মজিদ বলে,—কে হাসে অমনি কইরা?
জমিলা আসার পর আজ প্রথম মজিদের কণ্ঠে রুষ্টত শোনা যায়। তাই যো-জামিল মজিদকে ভেতরে আসতে দেখে ওপারে মুখ ঘুরিয়ে ফেলেছিল। লজ্জায়, সে তাড়ষ্ট হয়ে যায় ভয়ে। কেউ উত্তর দেয় না।
মজিদ আবার বলে,–মুসলমানের মাইয়ার হাসি কেউ কখনো হুনে না। তোমার হাসিও যানি কেউ হুনে না।
রহীমা এবার ফিসফিস করে বলে,—হুনলা নি? আওয়াজ কইরা হাসন নাই।
জমিলা আস্তে মাথা নাড়ে। সে শুনেছে। একদিন দুপুরে জমিলাকে নিয়ে রহীমা পাট বুনতে বসে। বাইরে আকাশে শঙ্খচিল ওড়ে, ‘আর অদূরে বেড়ার ওপরে বসে দুটো কাক ডাকাডাকি করে অবিশ্রান্তভাবে।
বুনতে বনতে জমিলা হঠাৎ হাসতে শুরু করে। মজিদ বাড়িতে নেই, পাশেব গ্রামে গেছে এক মরণাপন্ন গৃহস্থকে ঝাড়তে। তবু সভয়ে চমকে উঠে রহীমা বলে,–জোরে হাইস না বইন, মাইনষে হুনবো।
ওর হাসি কিন্তু থামে না। বরঞ্চ হাসতে হাসতে লুটিয়ে পড়ে মাটিতে। বিচিত্ৰভাবে জীবন্ত সে হাসি, ঝরনার অনাবিল গতির মতো ছন্দময় দীর্ঘ সমাপ্তিহীন ধারা।