তবু যাহোক, মানুষের দিল বলে একটা বস্তু আছে। দীর্ঘ বসবাসের ফলে মানুষে মানুষে মায়া হয়। তাই পরমাত্মীয়ের কোনো অন্যায়ে বুকে কঠিনতম আঘাত লাগে। ব্যাপারী আঘাত পেয়েছে। সে আঘাত এখনো শুকায়নি। তাই হয়তো দিলে শান্তি চায়।
মজিদ সভাকে প্রশ্ন করে,—ভাই সকল, আপনাদের কী মত?
ব্যাপারীকে নিরাশ করবে–এমন কথা কেউ ভাবতে পাবে না। কাজেই তার আবেদন মঞ্জুর হয়।
মজিদ সুবিচারক। অতএব স্থির হলো, এমনভাবে চাঁদা তোলা ইবে যে, আধখান আর অস্তই হোক–একজন লোক অন্তত একটা খরচ যেন বহন করে।
সভা ক্ষান্ত হবার আগে একবার আক্কাসের বদখেয়ালের কথা ওঠ। কিন্তু মোদকেবর মিঞার তখন জোশ এসে গেছে। রেগে উঠে সে বলে যে, ছেলে যদি আমন কথা ফের তোলে। তবে সে নিজেই তাকে কেটে দু-টুকরো করে দরিয়ায় ভাসিয়ে দেবে।
যতটা সুদৃশ্য করা হবে বলে কল্পনা করা হয়েছিল ততটা সুদৃশ্য না হলেও একটা পাকা গম্বুজওয়ালা মসজিদ তৈরী হতে থাকে। শহর থেকে মিস্ত্রী কারিগর এসেছে, আর গতব খাটাবার জন্য তৈরী গ্রামের যত দুস্থ লোক। মজিদ সকাল-বিকাল তদারক করে, আর দিন গোনে কবে শেষ হবে।
একদিন সকালে সে মসজিদের দিকে যাচ্ছে এমন সময় হঠাৎ মাঠের ধারে ফাল্গুনের পাগলা হাওয়া ছোটে। এত আকস্মিক তার আবির্ভাব যে, ঝকঝকে রোদাভাস আকাশের তলে সে-দমকা হাওয়া কেমন বিচিত্ৰ ঠেকে। তাছাড়া শীতের হাওয়া শূন্য জমজমাট ভাবের পর আচমকা এই দমকা হাওয়া হঠাৎ মনের কোনো এক অতল অঞ্চলকে মথিত করে জাগিয়ে তোলে। ধুলো-ওড়ানো মাঠের দিকে তাকিয়ে মজিদেব স্মরণ হয় তার জীবনের অতিক্রান্ত দিনগুলোর কথা। কত বছর ধরে সে বসবাস করছে। এ-দেশ? দশ, বারো? ঠিক হিসাব নেই, কিন্তু এ-কথা স্পষ্ট মনে আছে যে, এক নিরাক-পড়া শ্রাবণের দুপুরে সে এসে প্ৰবেশ করেছিল এই মহব্বতনগর গ্রামে। সে-দিন ছিল ভাগ্যান্বেষী দুস্থ মানুষ, কিন্তু আজ সে জোতজমি সম্মান-প্ৰতিপত্তির মালিক। বছরগুলো ভালোই কেটেছে এবং হয়তো ভবিষ্যতেও এমনি কাটবে। এখন সে ঝড়ের মুখে উড়ে-চলা পাতা নয়, সচ্ছলতায় শিকড়গাড়া বৃক্ষ।
অ্যাজ দমকা হওয়ার আকস্মিক আগমনে তার মনে ভবিষ্যতের কথাই জাগে। এবং তাই সারাদিন মনটা কেমন কেমন করে। লোকদের সঙ্গে আলাপ করে ভাসা-ভাসাভাবে, কইতে কইতে সে সহসা কেমন আনমনা হয়ে যায়।
সারাদিন হাওয়া ছোটে। সন্ধ্যার পরে সে হাওয়া থামে। যেমনি আচমকা তার আবির্ভাব হয়েছিল তেমনি আচমকা থেমে যায়। দোয় দরূদ পড়ছিল মজিদ, এবার নিস্তব্ধতার মধ্যে গলাটা চড়া ও কেমন বিসদৃশ শোনাতে থাকে। একবার কেশে নিয়ে গলা নামিয়ে এধার ওধার দেখে অকারণে, তারপর মাছের পিঠের মতো মাজারটার দিকে তাকায়। কিন্তু সেদিকে তাকিয়ে হঠাৎ সে চমকে ওঠে। রূপালী ঝালরওয়ালা সালু কাপড়টা এক কোণে উল্টে আছে।
সত্যিই সে চমকে ওঠে। ভেতরটা কিসে ঠক্কর খেয়ে নড়ে ওঠে, স্রোগে, ভাসমান নৌকার চড়ে ধাক্কা খাওয়ার মতো ভীষণভাবে ঝাকুনি খায়। কারণ, ঘরের মান আলোয় কবরের সে-অনাবৃত অংশটা মৃত মানুষের খোল। চোখের মতো দেখায়।
কার কবর এটা? যদিও মজিদের সমৃদ্ধির, যশ-মান ও আর্থিক সচ্ছলতার মূল কারণ এই কবরই; কিন্তু সে জানে না কে চিরঘুমে শায়িত এর তলে। যে-কবরের পাশে আজ তার একযুগ ধরে বসবাস এবং যে-কবরের সত্তা সম্পর্কে সে প্ৰায় অচেতন হয়ে উঠেছিল, সে কবরই ভীত করে তোলে তার মনকে। কবরের কাপড় উল্টানো নগ্ন ংশই হঠাৎ তাকে স্মরণ করিয়ে দেয় যে, মৃত লোকটিকে সে চেনে না। এবং চেনে না বলে আজ তার পাশে নিজেকে বিস্ময়করভাবে নিঃসঙ্গ বোধ করে। এ-নিঃসঙ্গত কালের মতো আদি অন্তহীন–যার কাছে মানুষের জীবনের সুখ-দুঃখ অর্থহীন অপলাপ মাত্ৰ।
সে-রাতে রহীমা স্বামীর পা টিপতে টিপতে মজিদের দীর্ঘশ্বাস শোনে। চিরকালের স্বল্পভাষিণী রহীমা কোনো প্রশ্ন করে না, কিন্তু মনে মনে ভাবে।
এক সময়ে মজিদই বলে,–বিবি, আমাগো যদি পোলাপাইন থাকত!
এমন কথা মজিদ কখনো বলে না। তাই সহসা রহীমা কথাটার উত্তর খুজে পায় না। তারপর পা টেপা ক্ষণকালের জন্য থামিয়ে ডান হাত দিয়ে ঘোমটাটা কানের ওপর চড়িয়ে সে আস্তে বলে,–আমার বড় সখ হাসুনিরে পুষ্যি রাখি। কেমন মোটা-তাজা পোলা।
প্ৰথমে মজিদ কিছুই বলে না। তারপর বলে,—নিজের রক্তের না হইলে কী মন ভরে? কথাটা বলে আর মনে মনে অন্য একটা কথার মহড়া দেয়। মহড়া দেওয়া কথাটা শেষে বলেই ফেলে। বলে, তাছাড়া তার মায়ের জন্মের নাই ঠিক!
তারপর তারা অনেকক্ষণ নীরব হয়ে থাকে। মজিদের নীরবতা পাথরের মতো ভারী। যে-নিঃশব্দ তা আজ তার মনে ঘন হয়ে উঠেছে সে-নিঃশব্দতা সত্যিকার, জীবনের মতো তা নিছক বাস্তব। এবং কথা হচ্ছে, পুষ্ট্যি ছেলে তো দূরের কথা, রহীমাও সে-নিঃশব্দতাকে দূর করতে পারে না। দূর হবে। যদি মনে নেশা ধরে। মজিদের নেশার প্ৰয়োজন।
ব্যথাবিদীর্ণ কণ্ঠে মজিদ আবার হাহাকার করে ওঠে,–আহা, খোদা যদি আমাগো পোলাপাইন দিত!
মজিদের মনে কিন্তু অন্য কথা ঘোরে। তখন মাজারের অনাবৃত কোণটা মৃত মানুষের চোখের মতো দেখাচ্ছিল। তা দেখে হয়তো তার মৃত্যুর কথা স্মরণ হয়েছিল। সঙ্গে সঙ্গে এ-কথাও স্মরণ হয়েছিল যে, জীবনকে সে উপভোগ করেনি। জীবন উপভোগ না করতে পারলে কিসের ছাই মান-যশ-সম্পত্তি? কার জন্যে শরীরের রক্ত পানি করা, আয়েশ-আরাম থেকে নিজেকে বঞ্চিত রাখা?