অবশ্য দুবছর তিন বছর অন্তর মাজারের গাত্রাবরণ বদলানো হয়, এবং বদলাবার খরচ বহন করে খালেক ব্যাপারই। খরচ করে তার আফসোস হয় না। বরঞ্চ সুযোগটা পেয়ে নিজেকে শতবার ধন্য মনে করে। এদিকে মজিদও লাভবান হয়, কারণ পুরানো গাত্রাবরণটি কেনবার জন্যে এ-গ্রামে সে-গ্রামে অনেক প্ৰাথী গজিয়ে ওঠে এবং প্রার্থীদের মধ্যে উপযুক্ততা বিচার করে দেখতে গিয়ে শেষ পর্যন্ত সে বেশ চড়া দামে বিক্রি করে সেটা। কাজেই ঝালরটার কোনোখানে যদি রঙ ঢটে যায়, বা সালু-কাপড়ের কোনো স্থানে ফাট ধরে তবে মজিদেব চিন্তা করার কারণ নেই। কিন্তু তবু জিনিসটার প্ৰতি কী যে মায়া–তার সামান্য ক্ষতি নজরে পড়লেও বুকটা কেমন কেমন করে ওঠে।
খাওয়া-দাওয়া শেষ হলে মজিদের সামনেই রহীম। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। আমেনা বিবির জন্যে সারাদিন আজ মনটা ভারী হয়ে আছে। একটা প্রশ্ন কেবল ঘুরে ফিরে মনে আসে। কেউ যদি হঠাৎ কিছু অন্যায় করে ফেলেও, তার কী ক্ষমা নেই? কী অন্যায়ের জন্যে আমেনা বিবির এত বড় শাস্তিটা হলো তা অবশ্য জানে না, তবু সে ভাবতে পারে না। আমেনা বিবি কিছু গর্হিত কাজ করতে পারে। আবার করেনি এ-কথাও বা ভাবে কী করে? কারণ খোদাই তো জানিয়ে দিয়েছেন মানুষকে সে অন্যায়ের কথা।
দীর্ঘশ্বাস ফেলে রহীমা বিড়বিড় করে বলে,–তুমি এত দয়ালু। খোদা, তবু তুমি কী কঠিন।
সে বিড়বিড় করে আর আওয়াজটা এমন শোনায় যেন মাজারের সালু কাপড়টা ছেড়ে ফড়িফড় করে। মুহূর্তের জন্যে চমকে ওঠে মজিদ। মন তার ভারী। রূপালী ঝালারের বিবৰ্ণ অংশটা কালো করে রেখেছে সে-মন।
হাওয়ায় ক-দিন ধরে একটা কথা ভাসে। মোদাব্বের মিঞার ছেলে আক্কাস নাকি গ্রামে একটি ইস্কুল বসাবে। আক্কাস বিদেশে ছিল। বহুদিন। তার আগে করিমগঞ্জের ইস্কুলে নিজে নাকি পড়াশুনা করেছে কিছু। তারপর কোথায় পাটের আড়াতে না তামাকের আড়ােত চাকরি করে কিছু পয়সা জমিয়ে দেশে ফিরেছে কেমন একটা লাটবেল টেব ভাব নিয়ে। মোদকেবর মিঞা ছেলের প্রত্যাবর্তনে খুশিই হয়েছিল। ভেবেছিল, এবার ছেলের একটা ভালো দেখে বিয়ে দিলে বাকী জীবনটা নিশ্চিন্ত মনে তসবি টিপতে পারবে। বিয়ে দেবার তাগিদটা এই জন্যে আরো বেশী বোধ করল যে, ছেলেটির রকম-সকম মোটেই তার পছন্দ হচ্ছিল না। ছোটবেলা থেকে আক্কাস কিছুটা উচৰ্কা ধরনের ছেলে। কিন্তু আজকাল মুরুব্বিদের বুদ্ধি সম্পর্কে পর্যন্ত ঘোরতর সন্দেহ নাকি প্ৰকাশ করতে শুরু করেছে। তবে তাকে পাঁচ ওক্ত নামাজ পড়তে দেখে মুরুব্বিারা একেবারে নিরাশ হবার কোনো কারণ দেখল না। ভাবলে, বিদেশী হাওয়ায় মাথাটায় একটু গরম ধরেছে। তা দুদিনেই ঠাণ্ডা হয়ে যাবে।
কিন্তু নিজে ঠাণ্ডা হবার লক্ষণ না দেখিয়ে আক্কাস অন্যের মাথা গরম করবার জন্যে উঠে-পড়ে লেগে গেলো। বলে, ইস্কুল দেবে। কোথেকে শিখে এসেছে ইস্কুলে না পড়লে নাকি মুসলমানদের পরিত্রাণ নেই। হ্যাঁ, মুরুব্বির স্বীকার করে, শিক্ষা ব্যাপারটা অত্যন্ত প্রয়োজনীয় কিন্তু গ্রামে কী দু-দুটো মক্তব বসানো হয়নি? সে-কি বলতে পারবে এ-কথা যে, গ্রামবাসীদের শিক্ষার কোনোখান দিয়ে কিছুমাত্র অবহেলা হচ্ছে?
আক্কাস যুক্তিতর্কের ধার ধারে না। সে ঘুরতে লাগল চরকির মতো। ইস্কুলের জন্যে দস্তুর মতে চান্দা তোলার চেষ্টা চলতে লাগল, এবং করিমগঞ্জে গিয়ে কাউকে দিয়ে একটা জোরাল গোছের আবেদন-পত্ৰ লিখিয়ে এনে সেটা সিধা। সে সরকারের কাছে পাঠিয়ে দিলো। কথা এই যে, ইস্কুলের জন্যে সরকারের সাহায্য চাই।
বাড়াবাড়ির একটা সীমা আছে। কাজেই একদিন মজিদ ব্যাপারীর বাড়িতে গিয়ে উঠল। কোনো প্ৰকার ভনিতার প্রয়োজন নেই বলে সরাসরি প্রশ্ন করল, -কী হুনি ব্যাপারী মিঞা।
ব্যাপারী বলে–কথাডা ঠিকই।
অতএব সন্ধ্যার পর বৈঠক ডাকা হলো। আক্কাস এল, আক্কাসের বাপ মোদাব্বের এল।
আসল কথা শুরু করার আগে মজিদ আক্কাসকে কতক্ষণ চেয়ে চেয়ে দেখল। দৃষ্টিটা নিরীহ আর তাতে আপন ভাবনায় নিমগ্ন হয়ে থাকার অস্পষ্টতা।
সভা নীরব দেখে আক্কাস কী একটা কথা বলবার জন্যে মুখ খুলেছে–এমন সময় মজিদ যেন হঠাৎ চেতনায় ফিরে এল। তারপর মুহূর্তে কঠিন হয়ে উঠল তার মুখ, খাড়া হয়ে উঠল কপালের ব্লগ। ঠাস করে চড় মারার ভঙ্গিতে সে প্রশ্ন করলে,–তোমার দাড়ি কই মিঞা?
আক্কাস সর্বপ্ৰকার প্রশ্নের জন্য তৈরী হয়ে এসেছিল, কিন্তু এমন একটা অপ্রত্যাশিত আক্রমণের জন্য মোটেই প্ৰস্তুত ছিল না। ইস্কুল হবে কী হবে না।–সে আলোচনাই তো হবার কথা। তার সঙ্গে দাড়ির কী সম্বন্ধ?
সভায় উপস্থিত সকলের দিকে তাকাল আক্কাস। দাড়ি নেই এমন একটি লোক নেই। কারো ছাটা, কারো স্বভাবত হাল্কা ও ক্ষীণ; কারো বা প্রচুর বৃষ্টিপানিসিঞ্চিত জঙ্গলের মতো একরাশ দাড়ি। মজিদ আসার আগে গ্রামের পথে-ঘাটে দাড়িবিহীন মানুষ নাকি দেখা যেত। কিন্তু সেদিন গেছে।
পূর্বোক্ত সুরে মজিদ আবার প্রশ্ন করে,—তুমি না মুসলমানের ছেলে–দাড়ি কই তোমার?
একবার আক্কাস ভাবে যে বলে, দাড়ির কথা তো বলতে আসেনি এখানে। কিন্তু মুরুব্বির সামনে আর যাই হোক, বেয়াদপিটা চলে না। কাজেই মাথা নত করে চুপ করে থাকে সে।
দেখে মোদকেবর মিঞা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে গা টিলা করে। এতক্ষণ সে নিশ্বাস রুদ্ধ করে ছিল এই ভয়ে যে, উত্তরে বেয়াড় ছেলেটা কী না জানি বলে বসে। মোদকেবর মিঞা বলে,–আমি কত কই দাড়ি রাখা ছ্যামড়া দাড়ি রাখ–তা হের কানে দিয়াই যায় না কথা।