থেকে থেকে মজিদ পানিতে ফুঁ দেয়। আর আবছা আলোয় তার ক্ষুদ্র চোখ চক্কর খায়। কখনো তার দৃষ্টি খালেক ব্যাপারীর ওপরও নিবদ্ধ হয়। আজ তার পানে তাকিয়ে মজিদের মনে হয়, ব্যাপারীর মেদবহুল স্ফীত উদরসম্বলিত দেহটি কেমন যেন অসহায়। একটু তফাতে সে যে মাথা নিচু করে বসে আছে, সে-বসে থাকার মধ্যে শক্তি নেই। সে কেমন ধ্বসে আছে, বিস্তর জমিজমাও ঠেস দিয়ে ধরে রাখতে পারেনি তার স্কুল দেহটা। চোখ আবার ঘোরে, চক্কর খায়। হলুদ রঙের বুটিদার চাদরে ঢাকা মুখটা এখান থেকে নজরে পড়ে না। তবু থেকে থেকে সেখানেই ঠক্কর খায় মজিদের ঘূর্ণমান দৃষ্টি।
এক সময় মজিদ উঠে দাঁড়ায়। গলা কেশে আস্তে বলে,—পানিটা দেন।
ব্যাপারীও তার লস্থূ দেহ নিয়ে উঠে দাঁড়ায়। এগিয়ে এসে পানিটা নেয়, তারপর আমেনা বিবির মৃত মানুষের মতো স্তব্ধ মুখের সামনে সেটা ধরে। আমেনা বিবি চোখ খুলে তাকায়, আস্তে, পাপড়ি খোলার মতো। তারপর চাদরের তলে একটা হাত নড়ে। সে হাতটি ধীরে ধীরে বেরিয়ে পাত্রটি যখন নেয় তখন একবার তার চুড়িতে অতি মৃদু ঝঙ্কার ওঠে।
আমেনা বিবি পত্রিটি কয়েক মুহুর্ত মুখের সামনে ধরে থাকে। তারপর তুলে ঠোঁটের কাছে ধরে। একটু পরে প্রগাঢ় নীরবতায় মজিদের সজাগ কানে সাবধানী বেড়ালের দুধ খাওয়ার মতো চুকচুক আওয়াজ এসে বাজে৷। পান করায় অধীরতা নেই। খোদার নামছোয়া পানি; তালাবের সাধারণ পানি নয়। তাছাড়া তৃষ্ণার পানিও নয় যে, শুষ্ক গলা নিমেষে শুষে নেবে সবটা। ধীরে ধীরে পান করে সে, বুকটা শীতল হয়। তারপর মুখ না ফিরিয়ে আস্তে শূন্য পাত্রটা বাড়িয়ে ধরে। পায়ের মতো সুন্দর হাত। মোমবাতির ম্লান আলোয় মনে হয়, সে-হাত শুধু সাদা নয়, অদ্ভুতভাবে কোমল।
হাতটি যখন আবার চাদরের তলে অদৃশ্য হয়ে যায় তখন মজিদ বলে,—তানারে উঠবার কন। এহন পাক দেওন লাগবো।
আমেনা বিবি উঠে দাঁড়ায়। দাঁড়িয়েই মনে হয় বসে পড়বে, কিন্তু সামান্য দুলেই স্থির হয়ে যায়।
–আমি দোয়া-দরূদ পড়তাছি। তানারে পাক দিবার কন। ডান দিক থিকা পাক দিবেন, আগে ডাইন পা বাড়াইবেন। বাড়ানের আগে বিসমিল্লাহ কইবেন।
মজিদ কোণে বসে। একবার সামনে দিয়ে যখন আমেনা বিবি ঘুরে যায়। তখন তার চোখ চকচক করে ওঠে আবছা অন্ধকারে। কালো রঙের পাড়ের তল থেকে আমেনা বিবির পা নিঃশব্দে বেরিয়ে আসে। একবার ডান পা আরেকবার বা। শব্দ হয় না। কাছাকাছি। যখন আসে তখন মজিদের ভেতরে সাপের গলাটা সামান্য চমকে পেছনে যায়, যেন ছোবল দেবে। মজিদ একবার ঢোক গেলে, তারপর কণ্ঠের সুর আবে মিহি করে তোলে।
একপাক, দুইপাক। আমেনা বিবি স্বপ্নের ঘোরে যেন হাঁটে। যে স্তব্ধতায় তার মুখ জমে আছে, সে-স্তব্ধতায় বিন্দুমাত্ৰ প্ৰাণ নেই। ও মুখ কখনো যেন কথা কয়নি, হাসেনি, কাঁদেনি। মনেও তার কিছু নেই। অতীতের স্মৃতির মতো মনে পড়ে কী একটা বাসনার কথা-বছরে বছরে যে-বাসনা অপূৰ্ণ থেকে আরো তীব্রতর হয়েছে। কী একটা অভাবের কথা, কী একটা শূন্যতার কথা। কিন্তু সে-সব অতীতের স্মৃতির মতো অস্পষ্ট। একটা মহাশক্তির সন্নিকটে এসে মানুষ আমেনা বিবির আর সুখ-দুঃখ অভাব-অভিযোগ নেই। একটা প্রখর, অত্যুজ্জল আলো তার ভেতরটা কানা করে দিয়েছে। সেখানে তার নিজের কথা আর চোখে পড়ে না।
একপাক, দুইপাক। তারপর তিন পাকে অর্ধেক। ক-পা এগুলেই মজিদকে পেরিয়ে যাবে। কিন্তু এমন সময় হঠাৎ বৈশাখী মেঘের আকস্মিক আবির্ভাবের মতো কী একটা বৃহৎ ছায়া এসে আমেনা বিবিকে অন্ধকার করে দিলো। অর্থ না বুঝে মুখ ফিরিয়ে স্বামীর পানে তাকাবার চেষ্টা করল, হয়তো-বা তাকে আলিঝালি দেখলাও। কিন্তু তারপর আর কিছু দেখল না, জানল না ক-প্যাঁচ পড়েছে তার পেটে, জানল না। মাজারের মধ্যে শায়িত শক্তিশালী লোকটির কী বলবার আছে, কপাক দিলে তাঁর অন্তরে দয়া উথলে উঠত।
ব্যাপারী বিদ্যুৎগতিতে উঠে পড়ে অস্ফুট কণ্ঠে অর্তেনাদ করে বলে,–কী হইল?
চোখের সামনে আমেনা বিবি মুছা গেছে। বুটিদার চাদরটা আর হাত দিয়ে আঁকড়ে ধরে রাখতে পারেনি বলে তার মুখটা খোলা। সে মুখে দাঁত লেগে আছে।
বাইরে মাজারে রহীমা আসে না। আজি আমেনা বিবি এসেছে বলে হয়তো আসত যদি না সঙ্গে থাকত ব্যাপারী। মাজার ঘরের বেড়ার ফুটোতে চোখ পেতে সে ব্যাপারটা দেখছিল। সঙ্গে হাসুনির মা-ও ছিল। রহীমা মনে মনে স্থির করেছিল, পাক দেওয়াচুকে গেলে আমেনা বিবিকে ভেতরে নিয়ে যাবে, সখা করে যে ফিরনিটা করেছে তা দেবে খেতে, তারপর দুয়েক খিলি পান চিবোতে চিবোতে দু’দণ্ড সুখ-দুঃখের গল্পও করবে। নিজে সে স্বল্প-ভাষী মানুষ, কিন্তু আমেনা বিবির হৃদয়ের সঙ্গে তার হৃদয়ের কোথায় যেন সমতা, যা-ই কথা হোক না কেন দেখতে দেখতে আলাপ জমে ওঠে। কিন্তু ফুটে দিয়ে রহীমা যে-দৃশ্য দেখল তারপর গল্পগুজবের আশা তাকে ত্যাগ করতে হলো। ব্যাপারীর লজ্জা কাটিয়ে বাইরে এসে সে আর হাসুনির মা অতিথিকে ভেতরে নিয়ে গেলো। নিয়ে গেলো পাজাকোলে করে, মুখে কথা ফোটাবার উদ্দেশ্যে। সখ করে তৈরী করা ফিরনির কথা বা পান খেয়ে দুদণ্ড গল্প করার কথা ভুলে গেলো।
মজিদ আর ব্যাপারী মাজার ঘরেই চুপ হয়ে বসে রইল, দু’জনের মুখে চিন্তার রেখা। তারপর মজিদ আস্তে উঠে অন্দর ঘরের বেড়ার পাশে বৈঠকখানায় গিয়ে হুঁকা ধরিয়ে আবার ফিরে এসে ব্যাপারীকে ডেকে নিয়ে গেলো। দুজনেই এক এক করে হুঁকা টানে, কথা নেই কারো মুখে।