মজিদ ও তরফ থেকে কিছু একটা আশা করলে কী হবে, তিনগ্রাম ডিঙিয়ে মহকবতনগরে এসে হামলা করার কোনো খেয়াল পীর সাহেবের মনে ছিল না। তার প্রধান কারণ তাঁর জঙ্গীফ অবস্থা। এ-বয়সে দাঙ্গাবাজি হৈ হাঙ্গামা আর ভালো লাগে না। সকরোদদের মধ্যে কেউ কেউ, বিশেষ করে প্রধান মুরিদ মতলুব খাঁ একটা জঙ্গী ভাব দেখালেও হুজুরের নিস্পৃহতা দেখে শেষ পর্যন্ত তারা ঠাণ্ডা হয়ে যায়। পীর সাহেব অপরিসীম উদারতা দেখিয়ে বলেন, কুত্তা তোমাকে কামড়ালে তুমিও কী উলটে তাকে কামড়ে দেবে? যুক্তি উপলব্ধি করে সাকরেদর নিরস্ত হয়। তবু স্থির করে যে, মজিদ কিংবা তার চেলারা যদি কেউ এধারে আসে। তবে একহাত দেখে নেওয়া যাবে। সে-দিন কালুদের কল্লা যে ধড় থেকে আলাদা করতে পারেনি, সে-জন্যে মনে প্ৰবল আফসোস হয়।
গ্রামের একটি প্রাণী। কিন্তু ব্যাপারটা ঠিক পছন্দ করে না। সে অন্দরের লোক, আর তার তাগিদটা প্ৰায় বাঁচা-মিরার মতো জোরাল। পীর সাহেবের সাহায্যের তার একান্ত প্রয়োজন। না হলে জীবন শেষ পৰ্যন্ত বিফলে যায়।
সে হলো খালেক ব্যাপারীর প্রথম বিবি আমেনা। নিঃসন্তান মানুষ। তেরো বছর বয়সে বিয়ে করেছিল, আজ তিরিশ পেরিয়ে গেছে। শূন্য কোল নিয়ে হা-হুতাশের সঙ্গে বুক বেঁধে তবু থাকা যেত, কিন্তু চোখের সামনে সতীন তনু বিবিকে ফি-বৎসর আস্ত আস্ত সন্তানের জন্ম দিতে দেখে বড় বিবির আর সন্থ হয় না। দেখা সওয়ার একটা সীমা আছে, যা পেরিয়ে গেলে তার একটা বিহিত করা একান্ত প্রয়োজনীয় হয়ে পড়ে। আওয়ালপুরে পীর সাহেবের আগমন সংবাদ পাওয়া অবধি আমেনা বিবি মনে একটা আশা পোষণ করছিল যে, এবার হয়তো বা একটা বিহিত করা যাবে। আগামী বছর তনু বিবির কোলে যখন নোতুন। এক আগন্তুক ট্যা-ট্যা করে উঠবে তখন সেও কণ্ঠ কাতর করে বলতে পারবে, তার গাটা কেমন-কেমন করছে, বুক ঠেলে কেবল যেন বমি আসতে চায়। তখন নানিবুড়ীর ডাক পড়বে। শেষে নানিবুড়ী মাথা নেড়ে হেসে রসিকতা করে বলবে, ওস্তাদের মীর শেষ কাটালে। কারণ যৌবনের দিক থেকে সে তানু বিবির মতো জোয়ার-লাগা ভরাগাঙ না হলেও একেবারে টসকোনো নয়, বোঁচা-চ্যাবকা কালো মানুষও নয়। রঙে ছাতা পড়বার উপক্রম করলেও এখনো সে-রঙ ধবধব করে, নাকে সতীনের মতো জ্বলজ্বলে নাকছবি না থাকলেও তা খাড়া, টিকালে। তার সন্তান আকাশের চাঁদের মতো সুন্দর হবেই।
কিন্তু মুশকিল হলো কথাটা পাড়া নিয়ে। প্রথমত, ব্যাপারীকে নিরালা পাওয়া দুষ্কর। দ্বিতীয়ত, চোখের পলকের জন্যে পেলেও তখন আবার জিহবা নড়ে না। ফিকির ফন্দি করতে করতে এ-দিকে মজিদ কাণ্ডটা করে বসল। কিন্তু আমেনা বিবি মরিয়া হয়ে উঠেছে। সুযোগটা ছাড়া যায় না। সারা জীবন যে মেয়েলোকের সন্তান হয়নি, পীর সাহেবের পানিপড়া খেয়ে সে-ও কোলে ছেলে পেয়েছে।
একদিন লজ-শরমের বালাই ছেড়ে আমেনা বিবি বলেই বসে, পীর সাবের থিক একটু পানিপড়া আইনা দেন না।
শুনে অবাক হয় ব্যাপারী। নিটোল স্বাস্থ্য বিবির, কোনোদিন জ্বরজারি, পেট-কামড়ানি পর্যন্ত হয় না।
—পানিপড়া ক্যান? আমেনা বিবি লজ্জা পেয়ে আলগোছে ঘোমটা টেনে সেটি আরো দীর্ঘতর করে, আর তার মনের কথা ব্যাপারী যেন বিনা উত্তরেই বোঝে।— তাই দোয়া করে মনে মনে।
উত্তর পায় না বলেই ব্যাপারী বোঝে। তারপর বলে,-আইচ্ছা। কিন্তু পরীক্ষণেই মনে পড়ে যে, পীর সাহেবের ত্ৰিসীমায় আর তো ঘোষা যায় না, অবশ্য পীর সাহেবকে মজিদ খোদ ইবলিশ শয়তান বলে ঘোষণা করলেও তবু বউ-এর খাতিরে পানিপড়ার জন্যে তাঁর কাছে যেতে বাধত না, কারণ পীর নামের এমন মাহাত্ম্য যে, শয়তান ডেকেও সে নামকে অন্তরে অন্তরে লেবাস-মুক্ত করা যায় না। গাভুরি-চাষী-মাঠাইলারা পারলেও অন্তত বিস্তর জমিজমার মালিক খালেক ব্যাপারী তা পারে না। কিন্তু সাধারণ লোকে যেটা স্বচ্ছন্দে করতে পারে সেটা আবার তার দ্বারা সম্ভব নয়। তা হলো শয়তানকে শয়তান ডেকে সমাজের সামনে ভরদুপুরে তাকে আবার পীর ডাকা। এবং সমাজের মূল হলো একটি লোক–যার আঙুলের ইশারায় গ্রাম ওঠে বসে, সাদাকে কালো বলে, আসমানকে জমিন বলে। সে হলো মজিদ। জীবনস্রোতে মজিদ আর খালেক ব্যাপারী কী করে এমন খাপে খাপে মিলে গেছে যে, অজান্তে অনিচ্ছায়ও দুজনের পক্ষে উলটো পথে যাওয়া সম্ভব নয়। একজনের আছে মাজার, আরেক জনের জমি-জোতের প্রতিপত্তি। সজ্ঞানে না। জানলেও তারা একাট্টা, পথ তাদের এক।
সে জন্যে সে ভাবিত হয়, দু’দিন আমেনা বিবির কান্নাসজল কণ্ঠের আকুতি মিনতি উপেক্ষা করে। অবশেষে বিবির কাতর দৃষ্টি সহ্য করতে না পেরেই হয়তো একটা উপায় ঠাহর করে ব্যাপারী।
ঘরে দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রীর এক ভাই থাকে। নাম ধলামিঞা। বোকা কিছিমের মানুষ, পরের বাড়িতে নির্বিবাদে খায় দায় ঘুমায়, আর বোন জামাইয়ের ভাত এতই মিঠা লাগে যে, নড়ার নাম করে না বছরান্তেও। আড়ালে আড়ালে থাকে। কাচিৎ কখনো দেখা হয়ে গেলে দুটি কথা হয় কি হয় না, কোনোদিন মেজাজ ভালো থাকলে ব্যাপারী হয়তো-বা শালার সঙ্গে খানিক মস্করাও করে।
তাকে ডেকে ব্যাপারী বললে : একটা কাম করেন। ধলামিঞা?
ব্যাপারীর সামনে বসে কথা কইতে হলে চরম অস্বস্তি বোধ করে সে। কেমন একটা পালাই-পালাই ভাব তাকে অস্থির করে রাখে। কোনোমতে বলে, –কী কন দুলামিঞা?