ঝড় আসছে। হু-হু করে, কিন্তু হাসুনির মা মুরগিটা খুজে পায় না। পেছনে ঝোপঝাড়ে দেখে, বাইরে যায়, ওধারে আমগাছে আশ্রয় নিয়েছে কিনা দেখে, বৃষ্টির ঝাপটায় বুজে আসা চোখে পিট-পিট করে তাকিয়ে কুরকুর আওয়াজ করে ডাকে, কিন্তু কোথাও তার সন্ধান পায় না। শেষে ভাবে, কী জানি, হয়তো বাপের মাচার তলেই মুরগিটা গিয়ে লুকিয়েছে। পা টিপে টিপে ঘরে ঢুকে মাচার তলে উকি মারতেই তার বাপ হঠাৎ কথা বলে। গলা দুর্বল, শূন্য শূন্য ঠেকে। বলে,—আমারে চাইরডা চিড়া আইনা দে।
মেয়ে ছুটে গিয়ে কিছু চিঁড়াগুড় এনে দেয়।
বাপ গবগাব করে খায়। ক্ষিধে রাক্ষসের মতো হয়ে উঠেছে।
চিঁড়ে কটা গলাধঃকরণ করে বলে,–পানি দে।
মেয়ে ছুটে পানি আনে। সর্বাঙ্গ তার ভিজে সপসাপ করছে, কিন্তু সেদিকে খেয়াল নেই। অনুতাপ আর মায়া মমতায় বাপের কাছে সে গলে গেছে। বাপের ব্যথায় তার বুক চিনচিন করে।
বুড়ো ঢকঢক করে পানি খায়। তারপর একটু ভাবে। শেষে বলে,–আর চাইরডা চিড় দিবি মা?
মেয়ে আবার ছোটে। চিঁড়া আনে আরো, সঙ্গে আরেক লোটা পানিও আনে।
দুদিনের রোজা ভেঙে বুড়ো ধনুকের মতো পিঠ বেঁকিয়ে মাচার ওপর অনেকক্ষণ বসে বসে ভাবে, দৃষ্টি কোণের অন্ধকারের মধ্যে নিবদ্ধ।
বাইরে হাওয়া গোঙিয়ে গোঙিয়ে ওঠে, ঘরের চাল হাওয়া আর বৃষ্টির ঝাপটায় গুমরায়। সিক্ত কাপড়ে দূরে দাঁড়িয়ে মেয়ে নীরব হয়ে থাকে। হঠাৎ কেন তার চোখ ছলছল করে। তবে ঘরের অন্ধকার আর বৃষ্টির পানিতে ভেজা দুঃখের মধ্যে সে-অশ্রু ধরা পড়বার কথা নয়।
অবশেষে বাপ বলে–মাইয়া তোর কাছে মাফ চাই। বুড়া মানুষ মতিগতির আর ঠিক নাই! তোরে না বুইঝা কষ্ট দিছি হে-দিন।
মেয়ে কী বলবে। বোকার মতো দাঁড়িয়ে থাকে। তারপর মুরগি খোজার অজুহাতে বাইরে ঝড়ের মধ্যে দাড়াতেই চোখে আরো পানি আসে হু-হু করে, অর্থহীনভাবে, আর বৃষ্টিতে ধুয়ে যায় সে-পানি।
সে-দিন সন্ধ্যায় বুড়ে চলে গেলো। কেউ বলতে পারল না গেলো কোথায়। ছেলেরা অনেক খোঁজে। আশেপাশে গ্রামের লোকদের জিজ্ঞাসাবাদ করে, মতিগঞ্জের সড়ক ধরে তিন ক্রোশ দূরে গঞ্জে গিয়েও অনেক তালাশ করে। কেউ বলে, নদীতে ডুবছে। তাই যদি হয় তবে সন্ধান পাবার জো নেই। খরস্রোতা বিশাল নদী, সে নদী কোথায় কতদূরে তার দেহ ভাসিয়ে তুলেছে কে জানে।
ঘরে বুড়ী স্তব্ধ হয়ে থাকে। যে তাঁর মৃত্যুর জন্যে এত আগ্ৰহ দেখাত সে আর কথা কয় না। হাসুনির মা দূর থেকে মজিদের মিষ্টি মধুর কোরান তেলাওয়াৎ শুনেছে অনেকদিন। সে আল্লার কথা স্মরণ করে বলে,–আল্লা-আল্লা কও মা।
বুড়ী তখন জেগে উঠে কয়েকবার শিশুর মতো বলে, আল্লা, আল্লা…।
মজিদের শিক্ষায় গ্রামবাসীরা এ-কথা ভালোভাবে বুঝেছে যে, পৃথিবীতে যাই ঘটুক জন্ম-মৃত্যু শোক-দুঃখ–যার অর্থ অনেক সময় খুজে পাওয়া ভার হয়ে ওঠে।–সব খোদা ভালোর জন্যেই করেন। তাঁর সৃষ্টির মর্ম যেমন সাধারণ মানুষের পক্ষে বোঝা দুষ্কর তেমন নিত্যনিয়ত তিনি যা করেন তার গুঢ়তত্ত্ব বোঝাও দুষ্কর। তবে এটা ঠিক, তিনি যা করেন মঙ্গলের জন্যই করেন। ঘটনার রূপ অসহনীয় হতে পারে, কিন্তু অন্তনিহিত উদ্দেশ্য শেষ পর্যন্ত মানুষের মঙ্গল, তার ভালাই। অতএব যে জিনিস বোঝার জন্যে নয়, তার জন্যে কৌতুহল প্ৰকাশ করা অর্থহীন!
ঠিক সে কারণেই বুড়ো কোথায় পালিয়েছে বা তার মৃতদেহ কোথাও ভেসে উঠেছে কিনা জানিবার জন্যে কৌতুহল হতে পারে, কিন্তু কেন পালিয়েছে তা নিয়ে বিন্দুমাত্র কৌতুহল হবার কথা নয়। যারা মজিদের শিক্ষার যথার্থ মর্ম উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়নি, তাদের মধ্যে অবশ্য প্রশ্নটি যে একেবারে জাগে না এমন নয়। কিন্তু সে-প্ৰশ্ন দ্বিতীয়ার চাঁদের মতো ক্ষীণ, উঠেই ডুবে যায়, ব্যাখ্যাতীত অজানা বিশাল আকাশের মধ্যে থাই পায়, না। যেখানে জন্ম-মৃত্যু, ফসল হওয়া-না-হওয়া, বা খেতে পাওয়া না-পাওয়া একটা অদৃশ্য শক্তির দ্বারা নিয়ন্ত্রিত, সেখানে একটি লোকের নিরুদ্দেশ হবার ঘটনা। কতখানি আর কৌতুহল জাগাতে পারে! যা মানুষের স্মরণে জাগ্রত হয়ে থাকে বহুদিন, তা সে-অপরাধের ঘটনা। মজিদের সামনে সেদিন লোকটি কেমন ছটফট করেছিল, পাপের জম্বালায় কেমন অস্থির করেছিল –যেন দোজখের আগুনের লেলিহান শিখা তাকে স্পর্শ করেছে। তারপর তার কান্না। শয়তানের শক্তি ধূলিস্মাৎ হয়ে গিয়েছিল সে-কান্নার মধ্যে।
এ-বিচিত্র দুনিয়ায় যারা আবার আর দশজনের চাইতে বেশী জানে ও বোঝে, বিশাল রহস্যের প্রান্তটুকু অন্তত ধরতে পারে বলে দাবী করে, তাদের কদর প্রচুর। সালুতে ঢাকা মাছের পিঠের মতো চিরনীরব মাজারটি একটি দুৰ্ভেদ্য, দুর্লঙ্ঘনীয় রহস্তে আবৃত। তারই ঘনিষ্ঠতার মধ্যে যে-মানুষ বসবাস করে তার দ্বারাই সম্ভব মহারহস্যকে ভেদ করা, অনাবৃত করা। মজিদের ক্ষুদ্র চোখদুটি যখন ক্ষুদ্রতর হয়ে ওঠে। আর দিগন্তের ধূসরতায় আবছা হয়ে আসে, তখনই তার সামনে সে-সৃষ্টি-রহস্য নিরাবরণ স্পষ্টতায় প্ৰতিভাত হয়–সে-কথা এরা বোঝে।
হাসুনির মা’র মনেও প্রশ্ন নেই। মাসগুলো ঘুরে এলে বরঞ্চ বাপের নিরুদ্দেশ হবার মধ্যে একটা অন্তর্নিহিত অর্থ খুজে পায়।–খোদার জিনিস খোদা তুইলা লইয়া গেছে।
তারপর মা’র প্রতি অগ্নি দৃষ্টি হানে।
–বাম আমাগো নেকবন্দ মানুষ আছিল। বুড়ী কিছু বলে না। খেলোয়াড় চলে গেছে, খেলবে কার সাথে। তাই যেন চুপচাপ থাকে।