হঠাৎ মজিদের গলা ঝনঝনি করে ওঠে।
—তুমি কী মনে করো মিঞা? তুমি কী মনে করে তোমার বিবি মিছা বদনাম করে? তুমি কী হলফ কইরা বলতে পারো তোমার দিলে ময়লা নাই?
যে-লোক কিছুক্ষণ আগে খালেক ব্যাপারীর মতো লোকের মুখের ওপর ঠাস ঠাসা জবাব দিচ্ছিল, মজিদের প্রশ্নে সে এখন বিভ্ৰান্ত হয়ে যায়। কোথা দিয়ে কোথায় তাকে আনে মজিদ, সে বোঝে না। মন ঘটতে গিয়ে দেখে সেখানে সন্দেহ–এতদিন পর আজ সন্দেহ! বহুদিন আগে তার বউ যখন চড়াই পাখীর মতো নাচত, হাসিখুশি উজ্জলতায় চারিদিকে আলো ছড়াত, তখন যে জনরব উঠেছিল সে-কথাই তার স্মরণ হয়। কোনোদিন সে-কথা সে বিশ্বাস করেনি। তখন কথাটা যদি সত্যি বলে প্ৰমাণিত হতোও, সে তাকে তালাক দিতে পারত। গলা টিপে খুন করে ফেললেও বেমানান দেখাত না। কিন্তু আজ এতদিন পরে যদি দেখে সেদিন তারই ভুল হয়েছিল, তবে সে কী করতে পারে? বউ আজ শুধু কঙ্কাল, পচন ধরা মাংসের রদি খোলস–তাকে নিয়ে সে কী করবে? অন্ধকার ভবিষ্যতের মধ্যে যে ভীতির সৃষ্টি হবে সে-ভীতি দূর করবে। কী করে?
মজিদ গলা চড়িয়ে ধমকের সুরে আবার বলে,–কী মিঞা? তোমার দিলে কী ময়লা আছে? তুমি কী ঢাকবার চাও কিছু, লুকাইবার চাও কোনো কথা?
মজিদ থামলে ঘরময় রুদ্ধনিশ্বাসের স্তব্ধতা নামে, এবং সে-স্তব্ধতার মধ্যে তার কেরাতের সুরব্যঞ্জনা আবার যেন আপনা থেকেই ঝঙ্কত হয়ে ওঠে। সে-ঝঙ্কার মানুষের কানে লাগে, প্ৰাণে লাগে।
তাহেরের বাপ এধার-ওধার তাকায়, অস্থির-অস্থির করে। একবার ভাবে বলে, না, তার দিলে কিছুই নাই, তার দিল সাফ। বুড়ী বেটির দেমাক খারাপ হয়েছে, তাকে কষ্ট দেবার জন্যেই অমন বুটমুঠ কথা বানিয়ে বলে। কিন্তু কথাটা আসে না মুখ দিয়ে।
অবশেষে অসহায়ের মতো তাহেরের বাপ বলে,–কী কমু? আমার দিলের কথা। আমি জানি না। ক্যামনে কমুদ দিলের কথা?
–কিছু তুমি ঢাকবার চাও, লুকাইবাব চাও?
অস্থির হয়ে ওঠা চোখে বুড়ো আবার তাকায় মজিদের পানে। তার মুখ কুলে পড়েছে, থাই পাচ্ছে না কোথাও।
—তুমি কিছু লুকাইবার চাও, কিছু ছাপাইবার চাও? তুমি তোমার মাইয়ারে তাইলে ঠ্যাঙাইছ ক্যান? তার গায়ে দঁড়া পড়ছে ক্যান? তার গা নীল-নীল হইছে ক্যান?
সভা নিশ্বাস রুদ্ধ করে রাখে। লোকেরাও বোঝে না ঠিক কোথা দিয়ে কোথায় যাচ্ছে ব্যাপারটা। তবে বিভ্রান্ত বুড়োটির পানে চেয়ে সমবেদন হয় না; বরঞ্চ তাকে দেখে মনে এখন বিদ্বেষ আর ঘূণা আসে। ও যেন ঘোর পাপী। পাপের জ্বালায় এখন ছটফট করছে। দোজখের লেলিহান শিখা যেন স্পর্শ করেছে তাকে।
হঠাৎ ঋজু হয়ে বসে মজিদ চোখ বোজে। তারপর সে বিসমিল্লাহ পড়ে আবার কেরাত শুরু করে। মুহুর্তে মিহি মধুর হয়ে ওঠে তার গলা, শান্তর ঝরণার মতো বেয়ে বেয়ে আসে, ঝরে ঝরে পড়ে অবিশ্রান্ত করুণায়!
তারপর সর্বসমক্ষে ঢেঙা বদমেজাজী বৃদ্ধ লোকটি কঁদতে শুরু করে। সে কাঁদে, কাঁদে, কেউ ব্যাঘাত করে না তার কান্নায়। অবশেষে কান্না থামলে মজিদ শান্ত গলায় বলে,–তুমি কিংবা তোমার বিবি গুণাহ কইরা থাকলে খোদা বিচার করবেন। কিন্তু তুমি তোমার মাইয়ার কাছে মাফ চাইবা, তারে ঘরে নিয়া যত্নে রাখব। আর মাজারে সিন্নি দিব পাঁচ পইসার।
মজিদ নিজে তার মাফ দাবী করে না। কারণ মেয়ের কাছে চাইলে তারই কাছে চাওয়া হবে। নির্দেশ তো তারই। তারই হুকুম তালিম করবে সে।
বুড়ো বাড়ি গিয়ে সটান শুয়ে পড়ে। তারপর চোখ বুজে চুপচাপ ভাবে। মাথাটা যেন খোলসা হয়ে এসেছে। হঠাৎ তার মনে হয়, সারা গ্রামের জমায়েতের সামনে দাঁড়িয়ে সে নির্লজ্জভাবে সায় দিয়ে এসেছে বুড়ীর কথায়। সে-কথার সত্যাসত্য সম্পর্কে প্রশ্ন তোলেনি, বরঞ্চ পরিষ্কারভাবে বলে এসেছে সে-কথা সত্যিই। এবং লোককে এ-কথাও জানিয়ে এসেছে যে, সে একটা দুর্বল মানুষ, এত বড় একটা অন্যায়ের কথা দোষিণীর আপনি মুখ থেকে শুনেও চুপ করে আছে কারণ তার মেরুদণ্ড নেই। সে-কথা সর্বসমক্ষে কেঁদে বুঝিয়ে দিয়ে এসেছে।
হঠাৎ রক্ত চড়াচড় করে ওঠে। ভাবে, উঠে গিয়ে চেলাকাঠ দিয়ে এ মুহুর্তেই বুড়ীর আমসিপান মুখখানা ফাটিয়ে উড়িয়ে দিয়ে আসে। কিন্তু কেমন একটা অবসাদে দেহ ছেয়ে থাকে। চুপচাপ শুয়ে কেবল ভাবে। পৌরুষের গর্ব ধূলিস্মাৎ হয়ে আছে যেন।
আর সে ওঠেই না। বুড়ী মাঝে মাঝে শান্তগলায় ছেলেদের প্রশ্ন করে,—দেখত, ব্যাটা মরল নাকি?
ছেলেরা ধমকে ওঠে মায়ের ওপর। বলে, কী যে কও! মুখে লাগাম নাই তোমার?
হতাশ হয়ে বুড়ী বলে,–তাই ক। আমার কি তেমন কপালডা!
আর মারবে না প্ৰতিশ্রুতি সত্ত্বেও বড় ভয়ে ভয়ে হাসুনির মা ঘরে ফিরে এসেছিল। ভয় যে, সেখানে যা বলেছে বলেছে, কিন্তু একবার হাতে নাতে পেলে তাকে ঠিক খুন করে ফেলবে বুড়ে। সে এখন অবাক হয়ে ঘুরঘুর করে, উকি মেরে বাপের শায়িত নিশ্চল দেহটি চেয়ে দেখে কখনো কখনো। কখনো বা আড়াল থেকে শুষ্ক গলায় প্রশ্ন করে,–ব্যাপজান, খাইবা না?
বাপ কথা কয় না।
দুদিন পরে ঝড় ওঠে। আকাশে দুরন্ত হওয়া আর দলে-ভারী কালো কালে মেঘে লড়াই লাগে; মহব্বতনগরের সর্বোচ্চ তালগাছটি বন্দী পাখীর মতো আছড়াতে থাকে। হাওয়া মাঠে ঘূর্ণিপাক খেয়ে আসে, তিৰ্যক ভঙ্গিতে বাজপাখীর মতো শো করে নেমে আসে, কখনো ভেঁাতা। প্ৰশস্ততায় হাতীর মতো ঠেলে এগিয়ে যায়।
ঝড় এলে হাসুনির মার হৈ হৈ করা অভ্যাস। হাসুনি কোথায় গেলো রে, ছাগলটা কোথায় গেলো রে, লাল কুটিওয়ালা মুরগিটা কোথায় গেলে রে; তীক্ষ্ণ গলায় চেঁচামেচি করে, আথালি-পাথালি ছুটোছুটি করে, আর কী একটা আদিম উল্লাসে তার দেহ নাচে।