ছুটি পেলাম। হেসে তাড়াতাড়ি বলে খতিব মিঞা।
মানে?
আমার অবসর হয়ে গেল। স্টিমারঘাট বন্ধ হল, আমার চাকুরিজীবনও শেষ হল। এবার উকিল আরবাব খান কিছু না বললে আবার দ্রুতকণ্ঠে বলে, অবসর হত একদিন, তা হয়েছে। সে-কথা নয়। ঠিক করেছি কুমুরডাঙ্গায়ই থেকে যাব।
উকিল আরবাব খানের চোখে কী-একটি ছায়া দেখা দেয়। হঠাৎ খতিব মিঞা অস্বস্তি বোধ করতে শুরু করে। সে বুঝতে পারে, আজ সকাল থেকে নিজেকে সহসা কুমুরডাঙ্গার অধিবাসী বলে গণ্য করতে শুরু করলেও এ-শহরের অধিবাসীদের চোখে সে বিদেশী মাত্র। এ শহরে পাঁচ-পাঁচটি বছর কাটালেও এ-শহরে ঠিক বাস করে নি, কারণ ডাঙায় থেকেও সে ঠিক ডাঙায় থাকে নি। তাছাড়া এ-শহরের সমাজে যদি একটি ছোটখাটো স্থান দখল করেছিল, কিছু মানসম্মানের অধিকারী হয়েছিল, সে-সবের সূত্র ছিল স্টিমার-কোম্পানি; সে-সূত্র ছিন্ন হয়েছে। এখন কোম্পানির রক্ষাবর্ম ছাড়া শুধুমাত্র খতিব মিঞা হিসেবে একাকী কুমুরডাঙ্গার অধিবাসীদের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে তাদের একজন বলে, তারা তাকে গ্রহণ করুক-এই প্রার্থনা নিয়ে। তার সহসা ভয় হয়, তারা কি তাকে আশ্রয় দেবে, তাদেরই একজন বলে গ্রহণ করবে?
উত্তেজিত হলে বা মনে কোনো আশঙ্কা দেখা দিলে খতিব মিঞার জবানে তোতলামির ভাব জাগে। তো-তত করে সে আবার বলে, বুঝলেন না, এ-শহরে মন পড়ে গিয়েছে। সেজন্যেই ঠিক করেছি এ-শহরে বাকি জীবন কাটিয়ে দেব।
উকিল আরবাব খানের মুখভাবে কোনো পরিবর্তন হয় না, তবে ছায়াটি যেন কাটে হয়তো বিরূপভাবটি ঈষৎ নরম হয়।
কাছারি-আদালতের সামনে কিছু সময় কাটিয়ে খতিব মিঞা আবার বাজারের দিকে রওনা হয়। বাজারের পথে প্রবেশ করার আগে সে-ই থমকে দাঁড়ায়, কারণ সে দেখতে পায় ডাক্তার বোরহানউদ্দিন এগিয়ে আসছে। তাকে দেখে খতিব মিঞার চোখ মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে, কারণ সে জানে লোক হিসেবে ডাক্তার বোরহাউদ্দিন বড় ভালো, তার মধ্যে কোনো কুটিলতা নেই, দেমাগ-অহঙ্কার নেই। তার সামনাসামনি হলে খতিব মিঞার মুখ দিয়ে অজস্র শব্দ বেরিয়ে আসে আথালি-বিথালিভাবে। তার অবসরপ্রাপ্তি, ক্ষতিপূরণের বিষয়ে বিবেচনাজ্ঞানশীল স্টিমার-কোম্পানির সিদ্ধান্ত, অবসরজীবন সম্বন্ধে নানা পরিকল্পনা, পাটকলের কর্মচারী-ছেলের ভবিষ্যৎ-কত কথাই-না সে বলে। হয়ত তার এই খেয়াল হয়, কুমুরডাঙ্গা শহরের অন্তরে স্থান পেতে চাইলে সে-শহরের অধিবাসীদের প্রথমে তার অন্তর উন্মুক্ত করে দেখানো দরকার। তবে কুমুরডাঙ্গার বিষয়ে বলতে গিয়ে সে সহসা বেসামাল হয়ে পড়ে।
প্রথম দিনই শহরটা ভালো লেগেছিল। বুঝলেন না, এ-শহরে বড় মায়া পড়ে গিয়েছে। কী করে কুমুরডাঙ্গা ছেড়ে যাই বলুন?
অবশেষে ডাক্তার বোরহানউদ্দিনকে রেহাই দিয়ে খতিব মিঞা বাজারের পথে পা বাড়ায়। ততক্ষণে মনে-প্রাণে বেশ উৎফুল্ল বোধ করতে শুরু করেছে, কী-একটা উত্তেজনায় পদক্ষেপ দ্রুত হয়ে উঠেছে। কয়েক পা এগিয়েছে এমন সময়ে কন্ঠের সম্ভাষণে ফিরে তাকিয়ে দেখে অপরিচিত একটি যুবক স্মিতমুখে তার দিকে দৃষ্টি দিয়ে দাঁড়িয়ে। যুবকটি তার পরিচয় দিলেও তাকে চিনতে পারে না, কিন্তু উচ্চকণ্ঠে বলে, কেন চিনব না, খুব চিনি আপনাকে। ধরতে গেলে আমি এ শহরেরই মানুষ। যা বাকি ছিল তা এবার পূর্ণ হল। বুঝলেন না, এ শহরেই থাকব ঠিক করেছি। যাবার জায়গার অন্ত নেই, তবে এ শহরে যেন শিকড় গজিয়ে ফেলেছি। হঠাৎ থেমে অপ্রত্যাশিতভাবে যুবকটি জিজ্ঞাসা করে, এদিকে লোকেরা পানের বরজ করে নাকি?
প্রশ্নটি অপ্রত্যাশিত হলেও অর্থহীন নয়। বাল্যকাল থেকে পানের বরজের প্রতি খতিব মিঞার একটি দুর্বোধ্য আকর্ষণ। সময়-অসময়ে খবরাখবর নিয়ে কোমলপ্রাণ পানগাতার লালন-পালনের কলাকৌশল সম্বন্ধে বেশ কিছু জ্ঞান অর্জন করেছে এই আশায় যে একদিন সুযোগ পেলে বরজ দেবার স্বপ্ন কার্যে রূপান্তরিত করবে। হঠাৎ পুরাতন শখটি জাগে তার মনে। ভাবে, কুমুরডাঙ্গায় কিছু জমি নিয়ে বাড়ি করতে পারলে একটা পানের বরজ দেবে। বুঝলেন না, এ জমিতে যা লাগাবেন তাই ফলবে। সোনার জমি আর কি।
বাজারের পথের দুপাশে এ-দোকানে সে-দোকানে কিছু কিছু সময় কাটায় খতিব মিঞা, কিন্তু ছলিম মিঞার সাইকেলের দোকানেই আড্ডা জমে যায়; হয়তো দুজনেই অবিলম্বে পরস্পরের গাছ-লতাপাতা করবার শখটি আবিষ্কার করে। তবে শীঘ্র পানের বরজের কথা ভুলে গিয়ে খতিব মিঞা আবার কুমুরডাঙ্গা সম্বন্ধে উৎসাহিত হয়ে এমন সব কথা বলতে শুরু করে যা আগে কখনো তার মাথায় আসে নি, এবং যা বলতে গিয়ে নিজেই কী-একটা ভাগাবেগে অভিভূত হয়ে পড়ে।
বুঝলেন না, সারা জীবন এখানে-সেখানে ঘরছাড়া হয়ে ঘুরে বেড়িয়েছি, এবার এক জায়গায় আরাম করে বসতে পারব। তবে সেটা বড় কথা নয়। আসল কথা, যে জায়গায় একবার মানুষের মনে পড়ে যায় সে-জায়গায় বাস করার সুযোগ পেলে সে আর কিছু চায় না। কিন্তু যে-সে জায়গায় কি আবার মন পড়ে? জায়গা এমন হওয়া চাই যার মাটি মনে ভয় সৃষ্টি করে না। কুমুরডাঙ্গায় পা দিয়েই বুঝেছিলাম এ-মাটিতে ভয় নেই। মৃত্যুর পর এমন মাটির বুকে আশ্রয় নিতে পারা বড় সৌভাগ্যের কথা।
ছলিম মিঞার স্ত্রর মধ্যস্থ গভীর রেখাগুলি পূর্ববৎ জেগে থাকলেও তাদের গভীরতা হ্রাস পায় যেন। অল্পক্ষণ নীরবতার পর সে জিজ্ঞাসা করে,