ওপরে এসে আপিস-ঘরে প্রবেশ করার আগে নদীর দিকে তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকিয়ে অনেকক্ষণ স্থির হয়ে দাঁড়িয়েছিল যদিও সে জানে নদীর বুকে যে-রহস্যময় লীলাখেলা চলে থাকবে তার কোনো চিহ্ন সেখানে নেই নদীর উপরিভাবে এখনো কিছু দৃশ্যমান হয় নি। তবু সামনে নদীর বুকে সে কী যেন দেখবার চেষ্টা করে। তার সে-চেষ্টা অর্থহীন বুঝে দূরে নদীর অপর তীরের দিকে দৃষ্টি দেয়। এ-ধারে কড়া রোদের বর্ষণ, কিন্তু ওপারে দিগন্তের কাছে আকাশ কালো করে মেঘ সঞ্চার হয়েছে। সে দাঁড়িয়েই থাকে, নদীর দিক থেকে যে-হাওয়া ভেসে আসে সে-হাওয়ায় তার পায়জামার নিম্নাংশ পতাকার মতো ফৎ করে আন্দোলিত হয়। খতিব মিঞা ছোটখাটো মানুষ, তবে চওড়া কপালের তলে অস্থিসব মুখটিতে দায়িত্বশীল মানুষের সহজ-গাম্ভীর্য : দীর্ঘদিন ধরে কোম্পানি তার ওপর যে-আস্থা প্রদর্শন করেছে সে-আস্থা তার ব্যক্তিত্বে প্রতিফলিত হয়ে-হয়ে এক সময়ে সে-ব্যক্তিত্বের একটি অবিভাজ্য অংশে পরিণত হয়েছে যেন।
আপিস-ঘরে ঢুকে কিছু-ভাঙ্গা একটি কাঠের চেয়ারে বসে পিঠদাঁড়া খাড়া করে সামনের টেবিলের দিকে চেয়ে কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে বসে থাকার পর সে স্থির করে, না, কিছুই করবার নেই, অন্য দিন এ-সময়ে মল-ঘরে তালা দিয়ে টিকিট-ঘরে গিয়ে বসত, আজ মাল-ঘরে বা টিকিট-ঘরে কোনো কাজ নেই। স্টিমার আসবে না সে-খবর প্রচার করবার জন্যে টিকিট-ঘরের জানলার সামনে টাঙ্গানো নোটিশটি যথেষ্ট না হলে অল্পবয়স্ক কেরানিটি এবং হেঁড়ে-কণ্ঠ লস্কর-সর্দার বাদশামি রয়েছে। বাদশা মিঞার বয়স হয়েছে, কিন্তু তার গলা কমজোর হয় নি।
খতিব মিঞা যখন একবার স্থির করে তার কিছুই করবার নেই তখন তার দুশ্চিন্তাটা কিছু লাঘব হয়, এবং এ-সময়ে সহসা সে অনুভব করে হাওয়াটা আর্দ্র-শীতল হয়ে উঠেছে। পার্শ্ববর্তী জানলা দিয়ে তাকিয়ে দেখে, অদূরে নদীর বুকেও একটা কালো ছায়ার সঞ্চার হয়েছে। মেঘ এদিকে আসছে। সেদিকে তাকিয়ে কতক্ষণ সে নিচে থেকে ভেসে-আসা কোলাহলের প্রতি কান দেয়। সে বুঝতে পারে, কোলাহলটি অন্য দিনের মতো নয়, কারণ তাতে যেন যাত্রা-উনখ লোকদের সুপরিচিত ব্যাকুলতা উত্তেজনা নয়, বিস্ময় বিহ্বলতার সঙ্গে মিশ্রিত একটি গভীর অসহায়তা প্রকাশ পায়; যেন যাত্রীর নয়, মানুষের অসহায়তাই। তবে কথাটি তার মনে স্পষ্ট রূপ ধারণ করে না : তেমন কোনো কথা স্পষ্টরূপে বুঝবার ক্ষমতা কোনোদিন সে রাখলেও আজ রাখে না। তাছাড়া, এ সময়ে হয়তো আর্দ্র-শীতল হাওয়ার জন্যে তার চোখটা লালচে হয়ে ওঠে এবং সঙ্গে সঙ্গে দেহে যে-আমেজ ধরে সে-আমেজের রস সন্ধানে সে মনোনিবেশ করে। নিন্দ্রা আলো-হাওয়ার মতো খোদাই নেয়ামত : সুযোগ-সুবিধা পেলে স্টেশনমাস্টার সে নেয়ামত উপভোগ করে থাকে। এবং নিশ্চিতভাবেই উপভোগ করে এই কারণে যে দরকার হলে নিমেষের মধ্যে সে পাখির মতো জড়তাশূন্য দৃষ্টি নিয়ে জেগে উঠতে পারে, সে-চোখে ঘুমের লেশ পর্যন্ত দেখা যায় না তখন।
তার নিদ্রাভঙ্গ হতে দেরি হয় না। বিলম্বিত ঢেউ-এ ভর করে লস্কর-সর্দার বাদশা মিঞার হেঁড়ে-গলা, তারপর তার পশ্চাতে আরেকটি গলা এবার সহসা তার কর্ণগোচর হয়। দ্বিতীয় গলা শহরের গণ্যমান্য উকিল কফিলউদ্দিনের হবে; উকিলের কণ্ঠস্বর ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে ওঠে, সিঁড়ি থেকে একবার তার জুতার এবং লাঠির শব্দ আসে। নিঃসন্দেহে সে ওপরের দিকেই আসছে। তারপর আরো পদধ্বনি শোনা যায়; হয়তো কুমুর ডাঙ্গার গণ্যমান্য উকিলকে অনুসরণ করে অনেক লোক ওপরের পথ ধরেছে।
দীর্ঘাকৃতি বৃদ্ধবয়সী উকিল কফিলউদ্দিন অবশেষে ওপরে যখন দৃশ্যমান হয় তখন খতিব মিঞা সিঁড়ির দিকে তাকিয়ে ভালো-মন্দ সর্বপ্রকারের পরিস্থিতির জন্যে তৈরি হয়ে দাঁড়িয়ে, তার চোখ পাখির চোখের মতো জড়তাশূন্য।
স্টিমারের কী হল? উকিল সাহেব জিজ্ঞাসা করে। প্রশ্নে আশঙ্কা নয়, গভীর বিরক্তি প্রকাশ পায়।
খতিব মিঞা কয়েক মুহূর্ত নীরবে দাঁড়িয়ে থাকে, যেন সে মুখের কথা হারিয়েছে। সে ভাবে, তারযোগে যে-সংবাদ এসেছে তার বেশি বলা উচিত হবে কিনা। কী উচিত কী উচিত নয়-সে-বিষয়ে কখনো সে মনস্থির করতে পারে না। কালেভদ্রে উচ্চপদস্থ কোনো কর্মচারী ঘাট পরিদর্শন করতে আসছে খবর পেলে সে কেমন বেসামাল হয়ে পড়ে। কখনো তার মনে হয়, পরিদর্শনকারী কর্মচারী ফ্ল্যাটটিকে নোংরা অবস্থায় পেলে তার মান-ইজ্জত যাবে। সবকিছু তুলে সে ফ্ল্যাটের পরিচ্ছন্নতার কাজে উঠে-পড়ে লেগে যায়, কতবার সে ওপরের অসমতল কালের হাওয়ায় বিবর্ণ, চামচিকা-বাদুড়ের মল বিষ্ঠায় চিত্রিত পাটাতনটি সাফ করায় তার ঠিক নেই; পরিদর্শকারী কর্মচারী এবং তার সাঙ্গপাঙ্গ সচরাচর ওখানেই বসে। অন্যবার ফ্ল্যাটের স্বাভাবিক অপরিচ্ছন্নতার কথা ভুলে গিয়ে হিসাবপত্রের দিকে মন দেয়। আবার কোনোবার মালপত্রের দিকে তার দৃষ্টি যায়। সেবার তার মনে সন্ত্রাস উপস্থিত হয় এই ভেবে যে পরিদর্শনকারী কর্মচারী হঠাৎ আবিষ্কার করবে তার দায়িত্বে সোপদকরা কোনো জিনিস গুম হয়ে গিয়েছে। মান-ইজ্জত কীভাবে যায় সে-বিষয়ে প্রত্যেক মানুষ তার নিজস্ব মতামত পোষণ করে থাকে। তহবিল তছরূপ করেছে-এমন অভিযোগে যে-মানুষ বিন্দুমাত্র বিচলিত হয় না, সে আবার অধার্মিকতার অভিযোগে গভীরভাবে আহত হয়, যে-মানুষ চরিত্রহীনতার অপবাদে অবিচল থাকে সেই আবার মিথ্যাবাদের অভিযোগে ক্রোধে অপমানে আত্মহারা হয়ে পড়ে। হয়তো খতিব মিঞা কখনো বুঝে উঠতে পারে নি তার মান ইজ্জতটা ঠিক কোথায়। তবে বর্তমান ক্ষেত্রে সমস্যাটি বড়ই জটিল মনে হয় এই কারণে যে সে দেখতে পায় তার মান-ইজ্জত নয়, কোম্পানির মান-ইজ্জতই সঙ্কটাপন্ন। কোম্পানির নামে সে যদি অন্যায় কিছু বলে ফেলে তাহলে কোম্পানির মান-ইজ্জত যাবে কি?