.
পরদিন ভো।রবেলায় নাশতার টেবিলে দুজনের কারো দিকে তাকাল না জরিনা। কোনো কথা বলল না। কেবল চায়ের পেয়ালটা নিজের দিকে টেনে নিল। আলীজাহ্ বসেছিল তার পাশে। সে বলল, ও–কী! বিস্কুট ডিম এগুলো খাবে কে?
সাদেক রোকসানাকে বললেন, দাও, ওকে এগিয়ে দাও।
রোকসানা দুটো প্লেট এগিয়ে দিল। সবাই ব্যস্ত হলো নাস্তায়।
হঠাৎ রোকসানা চোখ তুলে দেখে জরিনা কিছুই ছোঁয়নি। চায়ের পেয়ালা দুহাতে ধরে আছে। শুধালো, যাচ্ছো না যে!
খাবো না।
জরিনা চায়ের দিকে তাকিয়ে উত্তর করে। আরো জোরে চেপে ধরে পেয়ালাটা। গরম লাগে হাতে। তবু কিছুই মনে হয় না। ইচ্ছে হয়, চিৎকার করে বলে ওঠে, খাবো না, না, না। কিন্তু চিৎকার করতেও প্রবৃত্তি হয় না তার। সে বুঝতে দেবে না কী তার হয়েছে, বুঝতে দিয়ে দাম বাড়িয়ে দেবে না রোকসানার।
হাতের তালু অবশ হয়ে আসে।
সাদেক বলেন, আলীজাহ্ দিকে তাকিয়ে, অসুখ করেনি তো?
আলীজাহ্, জরিনার দিকে তাকিয়ে উত্তর দেয়, না–না। আমি বুঝেছি। সেই রবিনসন ক্রুসোর ছবিওয়ালা বাক্সের বিস্কুট চাই জরিনার। তাই না? দুপুরে এনে দেব।
সাদেক উঠে যেতে যেতে বলেন, উঁহু, মনে হচ্ছে অসুখ–বিসুখ। তুমি বেরুবার সময় ওকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেও, আলী।
সেদিন ও স্কুলেও যায়নি। বিকেলে নামলো বৃষ্টি। তখন ঈঠে এলো ছাদে। বড় বড় গাছ দোলানো, আকাশ নেভানো বৃষ্টি। কেবল দিগন্তের কাছে বলয়ের মতো এক ফালি উজ্জ্বলতা। আর বাতাস। নিম গাছের বড় ডালটায় দুটো কাক ভিজে ভিজে সারা হচ্ছে। আর চারদিক থেকে কী একটা আয়োজন যেন ক্রমেই উত্তাল হয়ে উঠছে। জরিনাব মনে হলো, এই তার আপন পৃথিবী। কতকাল ধরে সে অপেক্ষা করছে এমনি একটি বৃষ্টির–যে বৃষ্টি তাকে ধীরে ধীরে নিয়ে আসে ছাদে, যে বৃষ্টিতে ভেজা যায়, যে বৃষ্টির আড়ালে সাদেক, রোকসানা, আলীজাহ্ সবাই দূরে সরে যায়।
চিলেকোঠার দরোজায় দাঁড়িয়ে তখন মনে পড়লো সেই চড়ুই দেখা, বাবার জানুতে মাথা এলানো সন্ধ্যাটার কথা। মনে হলো আজকের জরিনা থেকে অবিকল একটা শরীর, একটা নিখুঁত প্রতিচ্ছবি, আলাদা হয়ে গেছে এক সময়ে। তাকে সে চিরদিনের মতো রেখে এসেছে সেদিনের সেই সন্ধ্যায়।
জরিনা চিলেকোঠার বাইরে এসে দাঁড়াল। দাঁড়াল বর্শার মতো তীক্ষ্ণ আর ঠাণ্ডা বৃষ্টিতে। সারা শরীর কন্টকিত হয়ে উঠলো ঠাণ্ডায়। চামড়ার কোমলতা ফেটে ফেটে পড়তে চাইলো বৃষ্টির আঘাতে। প্রথমে তীব্র ব্যথা, তারপর সেই ব্যথা সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়বার পর আর কোনো বোধ তার রইলো না। একরোখা সে দাঁড়িয়ে রইলো বৃষ্টির আঘাতের ভেতরে। একটা হিংস্র শক্তি যেন আজ তার ভেতরে জন্ম নিয়েছে। আর কোনো কিছু তাকে এখন ফেরাতে পারবে না। সে এখানেই থাকবে।
সেদিন রাতে খাওয়া শেষ হলে পর জরিনা সোজা তার নিজের কামরায় গিয়ে শুয়ে পড়লো। একটু পরেই রোকসানার পায়ের শব্দ কানে আসতেই জোর করে চোখ বুজে নিঃসাড় হয়ে। থাকলো। শব্দ শুনে বুঝতে পারলো রোকসানা তার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। একবার লোভ হলো চোখ মেলে তাকে দ্যাখে। কিন্তু না, চোখ সে খুলবে না।
চোখ মেলে দ্যাখে রোকসানা বাতি নিভিয়ে দিয়ে চলে গেছে। জরিনা নিঃশ্বাস ফেলল।
পরদিন রাতেও ঠিক তেমনি। রোকসানা এসে ফিরে গেল তবু চোখ খুলল না জরিনা। ঘুমের ভান করে বালিশে মাথা ডুবিয়ে পড়ে রইলো।
কিন্তু কালকের মতো আজ ঘুম এলো না সহজে। শুয়ে শুয়ে সে শুনতে পেল সাদেক ও ঘরে এসে হাই তুললেন, কথা বললেন রোকসানার সঙ্গে। একবার জরিনার কথা জিজ্ঞেস করলেন, তখন বুক শুকিয়ে গেলো জরিনার। তারপর তিনি শুয়ে পড়লেন। ভেজানো দরজার ফাঁক দিয়ে এতক্ষণ সরু একফালি আলো এসে পড়ছিল, টুক করে তা অন্ধকার হয়ে গেল।
আলীজাহ্ বার থেকে ফিরলো বেশ খানিকটা রাতে। বারান্দা দিয়ে যাচ্ছিল, খুট করে দরজা খুলে বেরিয়ে এলো জরিনা।
আলীচাচা।
স্–স্–স। বাবা ঘুমিয়েছে?
জরিনা ফিসফিস করে বলে ঘাড় কাত করে, হু! সবাই।
যা ঘুমোগে–জেগে থাকে না। বলতে বলতে আলীজাহ্ নিজের কামরায় চলে যায়। তার কালো ট্রাউজার অন্ধকারে একটু পরেই যায় মিলিয়ে, কিন্তু শাদা শার্ট বারান্দার শেষ মোড় অবধি দেখা যায়। জরিনা ঘরে ফিরে যায় না। পা টিপে টিপে এগোয়।
আলীজাহ্ মুখ ফেরাতেই ঘরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে শব্দ করে হেসে ওঠে জরিনা।
উঁহু, কী দুষ্টুমি হচ্ছে রাত দুপুরে।
না, ঘুম পাচ্ছে না।
বোস তাহলে।
আলীজাহ্ খুব করে জরিনার মাথার চুলগুলো নেড়ে দেয়। তারপর শার্ট খুলে আলনায় ছুঁড়ে ফেলে দাঁড়িয়ে বলে, অ্যাকটিং দেখবি?
অ্যাকটিং করে এলে, না আলীচাচা?
রিহার্সেল।
হ্যাঁ, হ্যাঁ দেখব। উঁহু অত কাছে এসো না, আমার ভয় করে।
আলীজাহ্ একবার তার সম্মুখে এসে তারপর দুহাত পেছনে বেঁধে পিছিয়ে যায় কয়েক পা। জরিনা অবাক হয়ে বড় বড় চোখ মেলে অপেক্ষা করে। দৃষ্টি স্থিরনিবন্ধ হয়ে থাকে আলীজাহ্ দীর্ঘ দেহের ওপর। আরো দীর্ঘ, আরো দূর মনে মনে হয় হঠাৎ তাকে। হাতের পেশী দৃঢ় হয়ে ওঠে, চাপটা হয়ে প্রায় সেঁটে যায় দুপাজরায়। তীক্ষ্ণ নাসারেখার দুপাশে হাড় ফুটে উঠতে চায় নিঃশ্বাসরে র আবেগে। কিছুক্ষণ পর আস্তে আস্তে ঘুরে আলীজাহ্ হেসে বলে, সম্রাট শাহজাহান। সিংহাসনের লোভে ছেলেরা তাকে বন্দি করে রেখেছে আগ্রা ফোর্টে। বুড়ো হয়ে গেছেন, প্যারালিসিসে এব.দক অবশ, সেই তখন–