তারপর আস্তে আস্তে জরিনার পাশে, নিচু টুলের ওপর বসলেন শাহ সাদেক আলী। মেয়েটা একটু চমকে উঠেই একহাতে আঁকড়ে ধরলো তার জানু আর ঠিক তেমনি তাকিয়ে রইলো সমুখের দিকে। সাদেক বললেন, কী দেখছিস? পাখি?
হ্যাঁ।
কী নাম পাখির?
চড়ুই।–চড়ুই আমাদের ঘরে রোজ কুটো ফেলে যায় জানো আব্বা।
তাই নাকি?
দুজনে সমুখের দিকে তাকিয়ে কথা বলে। কে কারো দিকে তাকায় না। তাকাবার প্রয়োজন হয় না! বাবাকে ভালো লাগে জরিনার। অন্যমনস্ক হয়ে পড়ে সে একটু। সাদেক তখন বলে চলেছেন, ঠিক আমাদের যেমন দুঃখ হয়, কষ্ট হয়, তেমনি পাখিদেরও।–ঝড় উঠলে ওরা থাকবে কোথায়? তাই আমাদের দালানে এসে খড়কুটো দিয়ে বাসা করে। তাড়িয়ে দিলে আল্লাহ দুঃখ পাবেন, বলবেন–আমার বান্দা একটা অসহায় জীবকে শুধু শুধু কষ্ট দিয়েছে। আল্লাহ আমাদের পাপ দেবেন।
জরিনার তখন এ কথায় কান নেই। তার মন তখন ঘুরছে অন্য প্রসঙ্গে। চট করে প্রশ্ন করে, আব্বা, পাখিদের নাম নেই?
নাম?–হ্যাঁ নাম আছে। আমরা ওদের কথা বুঝতে পারি না, তাই। সোলেমান নবী ছিলেন অনেকদিন আগে তিনি বুঝতে পারতেন ওদের কথা। দুনিয়ার সব জীব–জন্তুর সঙ্গে কথা বলতেন সোলেমান নবী।
আমি পারবো না?
পারবে বৈকি। যে ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের কেউ নেই–চকোলেট কেনবার পয়সা নেই–খুব কষ্ট যাদের তারা পাখি হয়ে যায়। তখন আর কোনো ভাবনা থাকে না। তাই বাচ্চাদের সঙ্গে পাখিদের এত ভাব।
ও বুঝেছি। তাই বুঝি আমার মাথার ওপরে চড়ুইগুলো বাসা করে, আব্বা?
হ্যাঁ, হ্যাঁ, তাই।
জরিনা কান পেতে থাকে পাখিদের কোনো সাড়া শব্দ যদি জেগে ওঠে। সাদেকও তন্ময় হয়ে থাকেন। কিন্তু আর ওরা ডাকে না। সাদেক জরিনার কাঁধে হাত রেখে নির্বাক হয়ে বসে থাকেন।
৩. এই সন্ধ্যার কথা
এই সন্ধ্যার কথা আজো ভুলতে পারেনি জরিনা। এই সন্ধ্যা তার জীবনে একটা স্বপ্ন জাগরণের মাঝপথে একক বেদনাময় একটি অনুভূতি হয়ে আছে। যে অনুভূতি জন নিয়েছিল সেই সন্ধ্যায় সেই পাখি, সেই জানু, সেই কণ্ঠস্বর আর কোনদিন ফিরে এলো না। জীবনের দূর–সমুদ্রে সরে যেতে যেতে সেই সন্ধ্যা তার স্মরণে আসে ইস্কুলে পড়া নাম ভুলে যাওয়া এক ইংরেজি কবিতার ঝোড়ো রাত্রিতে বাতিঘরের মতো।
এই সন্ধ্যার কথা প্রথম বড় করে মনে পড়েছিল কলকাতার বাসায় চিলেকোঠায় দাঁড়িয়ে একদিন বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে। তখন নূরুন্নাহারের বিয়ে দিয়েছেন সাদেক। জরিনা তখন সবে এগোরোয় পড়েছে। আর রোকসানা সংসারে এসেছে সপ্তাহ খানেক হলো।
প্রথম রাতে শোবার ব্যবস্থা হল আলাদা ঘরে। পাশের কামরায়। মা মারা যাবার পর এই তিন বছর সে ছিল সাদেকের কাছে। আজ তার মন ভীষণ ম্লান হয়ে গেল। ক্ষুব্ধতা নয়, বিষণ্ণতা। বিষণ্ণতায় ম্লান হয়ে সে খাবার টেবিলে বসে রইলো অনেকক্ষণ। তখন রোকসানা তার পাশে এসে দাঁড়াল। মাথায় হাত বুলিয়ে দিল খানিক। বলল, ঘুম পাচ্ছে?
এক মুহূর্তে তার বিষণ্ণতার মেঘ কেটে গেল। হঠাৎ একটা খুশির ঝাঁপটায় মন হয়ে উঠল রেশমি। চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে জরিনা বলল, না।
না! এত রাত অবধি জেগে থাকো নাকি তুমি? ছিঃ। আজ থেকে ঠিক দশটার সময় ঘুমুতে যাবে, কেমন?
তারপর বড়ো খাটে রোকসানা আর জরিনা গিয়ে শুলো। রোকসানা কত কী বলল, শুধোল– জরিনা যতক্ষণ পারলো উত্তর দিল তার। এই নতুন মানুষটার গাত্রবাস কেমন ছড়ানো ছড়ানো, আবছা। কোনদিন যাকে জানতো না, আজ সে ঠিক তার পাশাপাশি। জরিনা আস্তে আস্তে ঘুমিয়ে পড়ল কখন। ঘুমুতে ঘুমুতে মনে পড়লো, হাসপাতালে শেষ দিন যখন সে গিয়েছিল তখন মা তাকে বুকের কাছে টেনে নিয়েছিলেন। আচমকা ডান হাত মার পেটের ওপর পড়ে গিয়েছিল– কেমন উঁচু আর শক্ত, তাল তাল। লজ্জায় সরিয়ে আনতে পারেনি। কাঁধ গলা আড়ষ্ট হয়ে এসেছিল তার। আর সেই অবস্থায় মার কাঁধের ওপর মুখ রেখে ভারী মিষ্টি একটা ঘ্রাণ, মনে করতে পারছে না এমনি কী একটা হারিয়ে ফেলা সুগন্ধ পেয়েছিল জরিনা।
মাঝরাতে ঘুম ভেঙ্গে গেলে জরিনা প্রথমটা মনে করবার চেষ্টা করে কোথায় আছে সে? তার নতুন শোবার ব্যবস্থার কথা মনে পড়ে একটু একটু করে। তারপর ডানে বামে হাত। বুলিয়ে দেখে ফাঁকা। একা সে শুয়ে আছে। এক মুহূর্তের জন্যে ভয় করে তার। কিন্তু তা এক মুহূর্তের জন্যই। জানালা দিয়ে আবছা আলো এসে পড়েছে ঘরে। আর তার ভয় করে না। ভয়ের বদলে আক্রোশ জন্ম নেয়। আস্তে আস্তে উঠে চুপ করে বসে থাকে জরিনা।
তারপর বিছানা থেকে নেবে এসে দরোজার ফাঁক দিয়ে ও–ঘরে উঁকি দেয়। কিছু দেখা যাচ্ছে না। কেবল এখানে ওখানে কুয়াশার মতো আলোর পোচ। দরোজা একটু ঠেলতেই শব্দ করে ওঠে। কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে জরিনা। বুকের ভেতর চিব ঢিব করতে থাকে। আবার উঁকি দেয়। একটু পরে আঁধার সয়ে এলে তার চোখে পড়ে সাদেক আর রোকসানা পাশাপাশি শুয়ে আছে। অনেকটা মিউজিয়মে দেখা মমির মতো। রোকসানার একটা হাত সাদেকের বুকের ওপর বিছিয়ে আছে, এলানো চুলের গভীরে তার মুখ ডুবে আছে। আর সাদেক আধো পাশ ফিরে শুয়ে আছেন রোকসানার দিকে মুখ করে।
মুখ ফিরিয়ে নিল জরিনা। সারা গা শিরশির করে উঠলো জুরে পাওয়ার মতো। কুটি কুটি করে ছিঁড়তে ইচ্ছে হলো রোকসানার পরনে খয়েরি শাড়িটা। ইচ্ছে হলো, ছুটে গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয় তাকে। কী দরকার ছিল রাতের বেলায় তাকে অত আদর করবার? কেন তাকে সে ঠকালো? দরোজা থেকে ফিরে এসে ঘরের মাঝখানে অন্ধকারে দাঁড়িয়ে রইলো জরিনা। রোকসানাকে নিজের চেয়ে অনেক বড়, অনেক শক্তিশালী, অনেক দূরের মনে হলো তার। বাষ্পের মত ফুঁপিয়ে ওঠা করুণায় কান্নায়, আজ রাতেই মরে যাওয়ার ইচ্ছায় সে এ লশে মাথা রাখলো।