এমনি করে দিনের পর দিন।
কিন্তু একটা দরোজা পেরুলে পরের কামরা যেমন আগের কামরা নয়, ঠিক তেমনি মায়ের এন্তেকালের পর দুবোনের সম্পর্ক একটা নতুন চক্রে এসে বিকশিত হয়।
আরম্ভটা ছিল এ রকম–
বৃহস্পতিবার রাতে মারা গেলেন জরিনার মা। শনিবারের দুপুরের কথা। শাহ সাদেক আলী আলীজাহ্ তার পেয়ে সেইদিনই সকালে এসে পৌঁছেছেন। সেই তখন থেকে তিনি তার স্টাডিতে। অন্য দিনের মতই ইংরেজি বাংলা মিলিয়ে একগাদা দৈনিক কাগজের স্তূপ তার সমুখে। একের পর এক পড়ে যাচ্ছেন। কখনো পেন্সিল দিয়ে দাগ দিচ্ছেন কোনো খবরে। এতবড় বিয়োগের চিহ্ন বাইরে থেকে দেখে বোঝার উপায় নেই। কেবল পাশের টিপয়ে যেখানে রুপোর বাটিতে এলাচদানা থাকত আজ সেই টিপয়টা শূন্য।
বাইরের ঘরে একজন হাফেজ বসে পড়ছে পাক–কোরআন। আর আলীজাহ্ এই এতক্ষণে সবে বাথরুমে গেছে গোসল করতে। বেলা প্রায় আড়াইটা।
জরিনাকে নিয়ে বিছানায় শুয়ে ছিলেন তার মামানি। বিধবা মানুষ। সংসারে আপন বলতে আছে একমাত্র ছেলে বুলু। ম্যাট্রিক দিয়েছে এবারে। জরিনার মা মারা যাওয়ার খবর পেয়ে তাতিবাগান থেকে বুলুকে সঙ্গে করে এসেছেন কয়েকদিনের জন্য।
জরিনাকে ঘুম পাড়াতে গিয়ে নিজেই কখন ঘুমিয়ে পড়েছেন তিনি। হাত শিথিল হয়ে এসেছে জরিনার মাথার ওপর থেকে।
হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে গেল জরিনার। ধড়মড় করে উঠে বসে চারদিকে তাকিয়ে কেমন সব অচেনা মনে হলো। খুব নিচু গলায় একবার ডাকল–মা। রোদে আর দুপুরের বাতাস। কেউ সাড়া দিল না। তখন এক পা এক পা করে নিচে নেমে এলো জরিনা। বারান্দায় দাঁড়িয়ে কী ভাবল খানিক। চারদিকে কেউ নেই। শুধু বাথরুম থেকে শব্দ আসছে পানি ছিটানোর। সেই শব্দটা উৎকর্ণ হয়ে খানিকক্ষণ শুনে জরিনা এবার একরোখার মতো সিঁড়ি দিয়ে নামতে লাগল। নেমে বারান্দা পেরিয়ে বসবার পর। হাফেজ একবার তাকিয়ে দেখলেন কী দেখলেন না। তাঁর ক্লান্ত, বিলাপী, করুণ আবৃত্তি পেরিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে এলো সে। হাঁটতে লাগল হনহন করে।
খপ্ করে কে হাত ধরতেই জরিনা তাকিয়ে দেখে, বুলুভাই। হাত মুচড়ে ছাড়িয়ে নিয়ে ঘুম ঘুম গলায় বলে, ছাড়ো।
কোথায় যাচ্ছিস তুই?
মার কাছে।
চোখ তুলে বলেই নাবিয়ে নেয় জরিনা। পানিতে টাবুটুবু হয়ে আসে দুচোখ।
যেতে দাও আমাকে।
কিন্তু বুলু যখন তাকে কোলে তুলে নিল তখন এতটুকু বাধাও দিল না জরিনা। বাসায় ফিরে দেখে নূরুন্নাহার বারান্দায় তাকেই খোঁজাখুঁজি করছে। বুলু তার হাতে জরিনাকে তুলে দিয়ে বলে, কাণ্ড দেখেছ জরিনার? গোরস্তানে যাচ্ছিল, ভাগ্যিস আমি পথে দেখে ফেলেছিলাম।
নূরুন্নাহার তার কপালে হাত রেখে চিবুক ধরে শুধোয়, তাই নাকি?
কোনো কথা বলে না জরিনা। তখন তাকে নিয়ে ওপরে নিজের কামরায় উঠে আসে সে।
বলে, আয়, আমার পাশে ঘুমুবি।
বলে নিজেই তার ধূলো পা মুছিয়ে দেয়। নিজে শোয়। পরে কড়িকাঠের দিকে তাকিয়ে অনেকক্ষণ পরে শুধোয়, মাকে দেখবি?
বালিশের নিচে থেকে নূরুন্নাহার মায়ের বাঁধানো ফটো বার করে। দুজনে তাকিয়ে দেখে। তারপর হঠাৎ ফটো একপাশে সরিয়ে রাখে, জরিনাকে জড়িয়ে ধরে নূরুন্নাহার ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে। জরিনারও কান্না পায়। ভীষণ কান্না। কিন্তু কাঁদে না। নিজের বুকে অনুভব করে নূরুন্নাহারের কান্না।
.
প্রায় ছমাস পরের কথা।
দোতলার শেষ মাথায় যে গোল বারান্দা তার লাল মেঝেয় বসে রেলিংয়ের ফাঁকে দুপা ঝুলিয়ে দিয়ে জরিনা খুব এক মনে কিছুই ভাবছিল না। তার পা অবধি প্রায় উঠে এসেছে কচি আমগাছটা। হাতের ডানে বড় নিমগাছে বাতাস কাঁপছে। চারদিকে আসন্ন সন্ধ্যা। আকাশ হয়ে উঠেছে ভারী, ভিজে ভিজে, বেগুনি লাল আর হাতের শিরার মত এখানে ওখানে নীল–নীল। চড়ুইগুলো দিনমান কোথায় কোথায় উড়ে বেড়িয়ে ফিরে এসেছে তাদের আমগাছের ডালে। হুল্লোড় বাধাচ্ছে ক্ষণে ক্ষণে। আর ওপাশের নিমগাছটায় ডানা ঝাঁপটাচ্ছে বাসা ফেরৎ কয়েকটা কাক। দূরে ট্রাফিকের শব্দ, ভারী কিন্তু আবছা–একটা মোটা পর্দার ভেতর দিয়ে ছুঁয়ে পড়ছে সিরাপের মতো। রাস্তায় জ্বলে উঠেছে বাতি। কিন্তু দিনের আলো তখনো অন্ধকার নয় বলে ম্লান, ছোট ছোট দেখাচ্ছে, রাত হলে আস্তে আস্তে ওরা বড় হবে।
জরিনা চুপ করে এইসব দেখছিল। খুব অস্পষ্ট করে নিজেকে যেন মনে হচ্ছিল অমনি ম্লান, অমনি ছোট ছোট, দূরে দূরে। অই বয়সি অন্য যে কোন মেয়ে এত দীর্ঘক্ষণ চুপ করে বসে থাকতে পারত না। কিন্তু জরিনা পারে। বরং এইটেই তার ভালো লাগে।
আমগাছে এতক্ষণে চড়ুইগুলো শান্ত হয়ে বসেছে। আর কোনো শব্দ নেই। এই সন্ধ্যার ধূসর ছোটো একমুঠো শরীরগুলো ওড়াউড়িও করবে না আর। আকাশ থেকে নীল শিরাগুলো আস্তে আস্তে মিলিয়ে যাবে এক্ষুণি।
শাহ সাদেক আলী মগরেবের নামাজ আদা করে বারান্দা দিয়ে আসছিলেন, হঠাৎ অন্ধকারে আবছায়া পেছনটুকু দেখতে পেলেন জরিনার। বিরক্ত হলেন এদিকে এখনো কেউ বাতিটা জ্বেলে দিয়ে যায়নি বলে। ভাবলেন আলোটা নিজেই জ্বালাবেন। কিন্তু জ্বালালেন না। জরিনাকে হঠাৎ এভাবে বসে থাকতে দেখে কৌতূহলে মনটা তাঁর ভিজে উঠলো। পা টিপে পেছনে এসে দাঁড়ালেন তিনি।
নতুন করে মেয়েটাকে যেন চোখে পড়লো তার। নিজের সন্তানকে একেক সময় কত অপরিচিত মনে হয়, এ কি তিনি কখনো জানতেন? মনে হলো, পৃথিবীর দুপ্রান্তে দুটো দেশ–তারা দুজনে সেই দুদেশের অধিবাসী। আকাশে যেমন করে একটা কক্ষচ্যুত তারা অযুত অযুত বছরে একবার হঠাৎ জ্বালিয়ে দেয় বিপর্যয়ের আগুন, ঠিক তেমনি তিনি আজ ছিটকে এসে পড়েছেন দক্ষিণের এই অন্ধকার গোল বারান্দায়। কিছু বললেন না তিনি, শুধু স্তব্ধ হয়ে তার পেছনে দাঁড়িয়ে রইলেন অনেকক্ষণ।