কিংবা নূরুন্নাহারের বুদ্ধিতেই একটা নতুন খে, আবিষ্কার হলো, পাল্লা দিয়ে সিঁড়ি থেকে কে কত তাড়াতাড়ি নেবে আসতে পারে। তখন দুপুর বেলা। চারদিক সুম সুম করছে। দৌড়ে নাবতে গিয়ে ওপর থেকে গড়িয়ে পড়ল জরিনা। কপালের কাছে তেরছা হয়ে আধ ইঞ্চিটাক কেটে গিয়ে রক্ত বেরুতে লাগল দর দর করে। চিৎকারে করে উঠলো। যে মেয়েটি স্বভাবতই কিছু বলে না তার এই আকস্মিক চিৎকারে ঝন ঝন করে উঠলো গোটা বাড়ি। ওপর থেকে মা এলেন, এলেন সাদেক। ওদিকে নুরুন্নাহারই তখন উবু হয়ে পড়ে কামিজের খুট দিয়ে রক্ত মুছে দিচ্ছে জরিনার। জিজ্ঞেস কলে বলছে, আমি তো জানি না। এদিক দিয়ে যাচ্ছিলাম. চকার শুনে এসে দেখি বাবুর এই অবস্থা। আমি কী করব বল? কোন প্রতিবাদ করল না জরিনা। আর আশ্চর্য, সেই রক্তঝরা যন্ত্রণার মধ্যেই সে মুগ্ধ হলো, ঈর্ষান্বিত হলো বোনের মিথ্যে বলার অপূর্ব সাবলীলতা দেখে। কপালের সেই কাটা দাগটা জরিনার এখনো আছে একটা আবছা খয়েরি দাগ হয়ে।
এই তো সব দুষ্টুমি। তবু জরিনা সঙ্গ ছাড়বে না নূরুন্নাহারের।
একেকটা হঠাৎ পাওয়া ছুটির দুপুরে কিংবা কোনদিন রাতে কেন যে নূরুন্নাহার একলা থাকতে চাইতো, তন্ময় হয়ে যেত নিজেকে নিয়ে, জরিনা তা বুঝে উঠতে পারত না। তখন কাছে গেলে তাড়া খেয়ে ফিরে আসতে হতো। কিংবা এমনও হয়েছে, নূরুন্নাহার ডুবে গেছে নিজের প্রসাধনে। আয়নার সামনে বসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা চুল বাঁধা, রিবনে বো ভোলা, চলছে তো চলছেই। আর পাউডার পাফ আর ভ্রু আঁকা। তখন জরিনাকে সে তাড়িয়েও দিত না, কথাও বলতো না–তার উপস্থিতিকে একটা করুণার দৃষ্টি দিয়েও যেন স্বীকার করতে চাইতেন নূরুন্নাহার। আর জরিনার মনে হতো একটা নতুন মানুষ, একটা বাইরের মানুষকে সে দেখছে। অনেকক্ষণ–সে দাঁড়িয়ে থাকতো, দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে তার চিবুক অবনত হয়ে আসত–প্রায় দুই ছুঁই হতো গলার ভাজটার কাছে। বু নূরুন্নাহার নির্বাক, নিস্পৃহ।
একদিন রাতের বেলায় খেয়ে দেয়ে জরিনা গিয়েছিল নূরুন্নাহারের কামরায়।
বছরখানেক হলো নূরুন্নাহার বড় শোবার ঘরের পাশে ছোট কামরাটায় থাকে আর জরিনা মায়ের কাছে। জরিনা গিয়ে দেখে বিছানায় উপুড় হয়ে সে খাতায় উল্টোদিক থেকে প্রথম পাতায় কী লিখছে। জরিনা কাছে যেতেই নূরুন্নাহার খপ করে কোমর বাঁকিয়ে আধো উঠল। কিছু বলার আগেই কৌতূহল ততক্ষণে জরিনার মুখে কথা এনে দিয়েছে।
কী লুকোলি, আপা?
সে কথার জবাব না দিয়ে নূরুন্নাহার সোজা তর্জনী দেখিয়ে দেয়।
পালা, পালা শীগগীর। বলে দেব মাকে? আমার পড়া ডিস্টার্ব করছে?
বলনা আপা।
না।
বালো।
বলছি–না।
জরিনা আর প্রশ্ন করে না। কিন্তু চলেও যায় না। তেমনি খাটের বাজু ধরে দাঁড়িয়ে থাকে। কী ভেবে নূরুন্নাহার শরীরের ভঙ্গিটাকে বদলায়, মুখটাকে শিথিল আর মসৃণ করে আনে। উঠে বসে বলে, নাহ, তোর জ্বালায় কিছু করবার যো নেই। তুই ছেলে মানুষ–তুই কী বুঝবি? যখন ক্লাস এইট নাইনে পড়বি তখন।
জরিনা বড় বড় চোখ মেলে তাকিয়ে থাকে। মনে একটু দুঃখও হয় হঠাৎ এই বয়সের পার্থক্যটা আঙ্গুল তুলে দেখিয়ে দেয়ার জন্য। রাগ হয় দেমাক দেখে। কিন্তু রাগের চেয়েও বেশি হয় কৌতূহল আর ঈর্ষা।
নূরুন্নাহার বলে, দাঁড়া পেছন ফিরে। ছাড়বিনে যখন, দেখাচ্ছি। কাউকে বলতে পাবিনে কিন্তু। দাঁড়া শীগগীর–আর একটু ঘুরে। যখন ফিরতে বলব তখন তাকাবি–তার আগে না, খবরদার।
জরিনা পেছন ফিরে শব্দ শুনতে পায় নূরুন্নাহারের খাতা থেকে পাতাটা ছিঁড়ে ফেলল। তারপর ভাঁজ করার আওয়াজ। কিন্তু ফিরতে বলল না তাকে। নূরুন্নাহার সমুখে এলো তার। হাতে কাগজটা। বলল, একবার দেখতে পাবি–। এক সেকেণ্ড।
জরিনা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতে থাকে। নূরুন্নাহার ভাজ খুলে কাগজটা চোখের সামনে মেলে ধরেই টুক করে সরিয়ে নেয়। সঙ্গে সঙ্গে জরিনার চোখে শুধু কতকগুলো হিজিবিজি লেখা জীবন্ত হয়ে, তরঙ্গ হয়ে উঠেই মিলিয়ে যায়। একটা অক্ষরও সে বুঝতে পারে না।
বলে, কী।
কী আবার? দেখালাম তো।
তারপরই খপ করে জরিনাকে টেনে নিয়ে খাটের উপর বসিয়ে দেয়, কাগজটা আবার পুরোপুরি চোখের সমুখে মেলে ধরে, একেবার পেছন ফিরে দরোজার দিকে দেখে নেয়, ফিসফিস করে বলে, কিছু পড়তে শিখিস নি? এই দেখ–ভ–এ আকার ভা, ল–এ ওকার লো, ব–এ আকার বা, আর দন্ত্য স–এ আকার সা–ভালোবাসা।
জরিনা পড়তে পারে এবার। অবাক হয়ে দেখে সারাটা কাগজ জুড়ে শুধু ওই একটি শব্দই বারবার লেখা। কেন যেন দুপ দুপ করতে থাকে তার বুক, এত আস্তে এত কানের কাছে মুখ রেখে নূরুন্নাহার কথা বলছে।
জানিস, বাবা মাকে ভালোবাসে।
জরিনার খুব অবাক লাগে। মনে মনে ছবিটা ভেসে ওঠে, বাবা চেয়ার টেবিলে বসে লিখে চলেছেন। বাবা দিনরাত লেখেন। কিন্তু কই, সে গিয়ে পড়লে বাবা তো এমনি করে কাগজ লুকোন না। বাবা কি এমনি সব কাগজে লিখে মা–কে দেন? মাঝে মাঝে মানুষজন আসে। এসে, সব লেখা কাগজপত্র নিয়ে যায়। বাবা তাহলে ওদেরও ভালোবাসেন।
নুরুন্নাহার হঠাৎ বলে, খবরদার, কাউকে বলবি না, মাকেও না।
না না না।
জরিনা শুধু মুখে বলে না, মাথা নেড়েও উত্তর করে।
চোখ ছুঁয়ে বল্ কাউকে বলবি না –যা পালা শীগগীর।
জরিনার গা কেমন শিরশির করতে থাকে–ঠিক দুপুর রাতে ঘুম থেকে উঠে হঠাৎ অন্ধকার দেখলে যেমন হয়, ঠিক তেমনি।