আলীচাচা একদিন ছবি করবেনই।
.
কিন্তু আজ এই বৃষ্টি থামবার পর কোন কবিতা লিখতে চেয়েছিল জরিনা? কী ভাবছিল সে? না, না, না। নাম—অমর নাম পৃথিবীতে একটিও নেই– যে নাম জন্ম নিয়েছে জ্বলন্ত, দীর্ঘ, রক্তিম, আদিম অগ্নিশিখা থেকে। নেই, নেই, নেই। পনেরো বছর বয়সে পুরো হাক্সলি। জরিনা জানে, খুব ভালো করেই জানে, পনেরো বছর বয়সে সে পড়েছে অডাস হাক্সলি রূপকথার সমান আগ্রহ নিয়ে পড়ে শেষ করেছে এমন মেয়ে গোটা দেশে আর একটিও জন্মায়নি। আর এখন তার বিষ–ফল ভুগতে হচ্ছে। কিন্তু হাক্সলি তাকে পড়তে বলেছিল কে?
হ্যাঁ, মনে পড়েছে। নূরু আপার বাসায় একদিন সে একটা ইংরেজি পত্রিকা দেখেছিল। নূরু আপার স্বামী হামিদুর রহমান ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপক। সেই পত্রিকায় জরিনা দেখেছিল হাক্সলির ছবি। থ্রি কোয়ার্টার প্রোফাইল। চশমার একটা তেকোণা ছায়া, প্রায় দাঁড়া ছড়ানো মাকড়শার মতো, পড়েছে চোয়ালের হাড়ে। অদ্ভুত মনে হয়েছিল মানুষটাকে জরিনার। মনে হয়েছিল, কেন মনে হয়েছিল এই হাস্যকর কথাটি তা সে জানে না, লোকটা কী খেয়ে বেঁচে থাকে? কোন দর্জির দোকান থেকে কাপড় কাটিয়ে থাকে এই লেখক? আর তার বিছানার চাঁদরের রঙ?
জরিনা জানে, জরিনা অনেকদিন দেখছে, মাঝে মাঝে যাদের নিয়ে এইসব কথা মনে হয়, যা অন্তরঙ্গ, অথচ মুখে বললে শোনাবে হাস্যকর, সেই মানুষগুলো তার জীবনে কোনো না কোনো নতুন মানে যোগ করে দিয়েছে।
সেদিনই জরিনা হামিদ দুলাভাইয়ের কাছ থেকে প্রথম নিয়ে এসেছিল হাক্সলির বই। বেতের গোল চেয়ারে দুপা বুকের কাছে ছড়িয়ে তুলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সে মেতে থেকেছে এই নতুন লেখকের বই নিয়ে, যার চোয়ালের হাড়ে একটা ছবিতে ছায়া ফেলেছিল দাঁড়া ছড়ানো মাকড়শা।
সেই হাক্সলি, ঠিক মনে পড়ছে না, কোথায় যেন বলেছিলেন, আজো মনে পড়ে জরিনার আমাদের এই পৃথিবী অন্য কোনো গ্রহের নরক।
কথাটা ভালো লেগেছিল তার। যেমন করে তার ভালো লাগে আলীজাহ্ কথা। মনে হয়েছিল তার নিজেরই ভাবনায় এতকাল এই কথাটা জন্ম নিয়ে প্রচ্ছন্ন থেকে প্রতীক্ষা করছিল মুক্তির জন্যে। এত সহজ, এত গভীর, এত চেনা। এই পৃথিবী, এই সবুজ পৃথিবী, এই আলোয় জ্বলা আঁধারে ডোবা পৃথিবী অন্য কোনো গ্রহের নরক। তাহলে স্বর্গ কোন গ্রহ? সেখানে কি লেখক নেই একজনও?–হাক্সলির মতো?–যে এমনি চেনা গলায় বলতে পারে এই গ্রহ অন্য কোনো গ্রহের স্বর্গ?
তারপর অনেকদিন পরে, যখন তার অনেকদিন হলো পড়া হয়ে গেছে হাক্সলি, হাক্সলির ওপরে হঠাৎ বিতৃষ্ণা জন্মে জরিনার।
আলীচাচা বলেছেন—সবার চেয়ে বড় কথা, হৃদয়কে যা স্পর্শ করে একমাত্র তা–ই সত্য।
২. জরিনার মা মারা গিয়েছিলেন
জরিনার মা মারা গিয়েছিলেন সন্তান হতে গিয়ে, প্রায় তিনদিন যমে-মানুষে টানাটানির পর। মা আর সন্তান বাচলো না কেউই। শাহ সাদেক আলী তখন উত্তর বাংলা সফরে বেরিয়েছেন।
আলীজাহ্ তার করল তিন জায়গায়। সেই তার সাদেকের হাতে গিয়ে যখন পৌঁছুলো আর যখন তিনি ফিরে এলেন, তখন দাফন হয়ে গেছে। সাদেক নিশ্চল হয়ে বসে রইলেন তার স্টাডির চামড়া–মোড়া গভীর চেয়ারে।
সাদেক কাছে ডাকলেন না কাউকে। না নূরুন্নাহার, না জরিনা। আলীজাহ্ তাদের আগলে রইলো। সারা বাড়ি ভরে উঠলো পাষাণ–চাপা নিস্তব্ধতায়। একটা মানুষ যে সহস্র হয়ে আলো করে থাকতে পারে, তা কে জানতো? কোনদিন সরাসরি সম্পর্ক ছিল না সংসারের সঙ্গে সাদেকের। এখন সেটুকুও আর রইলো না। হঠাৎ যেন এক সাগর–সংগ্রামে এসে দাঁড়িয়েছেন শাহ সাদেক আলী। যেন তার এই স্তব্ধতার, অনুপস্থিতির, স্বল্পভাষীতার জন্ম নেই, মৃত্যু নেই আর; আর, উত্থান নেই, পতন নেই; কেবলি প্রবাহিত হচ্ছে একটি স্থির অকল্প দীর্ঘ সরলরেখা।
বিপরীতে পরস্পর ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠলো দুবোন, জরিনা আর নুরুন্নাহার। পিঠেপিঠি দুবোন নয় তারা, তখন তারা সাত আর তেরো। নূরুন্নাহার ছিল চপল দুষ্টু। তার কপাল ছিল আধখানা চাঁদের মত ছোট আর চাপা, নাক তিলের মতো এই এতটুকু। আর প্রশস্ত দুই পাতলা ঠোঁটে রেশমি রক্তিমতা। দুষ্টুমিটা ছিল ওর নেশা। চতুরালি ছিল ওর স্বভাব। উল্টো দিকে জরিনা তার অপেক্ষাকৃত প্রশস্ত কপাল, চাঁদের মত গোল মুখ আর ক্রীম রঙা রেকাবির মতো গাল–যা ক্ষণে ক্ষণে হয়ে উঠতো লাল–আর ব্রাউন রঙ চুল নিয়ে নুরুন্নাহারের পাশে ছিল অনেকটা বোকা, মন্থর, হয়ত কিছুটা সাবধানী। চট করে দেখলে বাইরের কেউ মনে করেও বসতে পারত যে, মেয়েটা বোবা–এমনি তার চাহনি, এমনি তার চলন।
নূরুন্নাহারের সমস্ত দুষ্টুমি গিয়ে পড়ত জরিনাকে নিয়ে। জরিনার কান্না পেত। কিন্তু তবু নূরুন্নাহারের সঙ্গ থেকে এতটুকু দূরে সরে যেত না সে।
বৃষ্টি পানিতে সমুখের পথটা নদী হয়েছে তো নূরুন্নাহারকে নৌকা বানাতে হবে। আর তার কাগজ জোগাবে জরিনা নিজের খাতা ছিঁড়ে–এতে তার আনন্দ। অথচ একটা নৌকাও যদি কোনদিন সে ছুঁতে দিয়েছে জরিনাকে। আর সন্ধ্যে বেলায় খাতার এ হেন অবস্থার জন্যে মাস্টারের বকুনিটুকুও খেতে হলো জরিনাকে। নূরুন্নাহার তখন মুখ টিপে হাসছে। এমন কি মাস্টার নূরুন্নাহারের লক্ষ্মীপনার আদ তুলে ধরে জরিনাকে তখন বলছে–এইতো তোমারই বোন, তার খাতা দেখ দিকি–কেমন ঝকঝক করছে।