আর হঠাৎ মনে পড়ল রোকসানার–আলীজাহ্ কি খুশিটাই না হবে যখন সে দেখবে তার নিজের কামরা। দোতলার উত্তর–পূর্ব দিকের কামরাটা নির্দিষ্ট হয়েছে আলীজাহ্ জন্যে। যদিও নকশায় কামরাটা দাগ দিয়ে রেখেছে জরিনা, তবু সাজিয়ে তোলা তো তারই হাতে। আলীজাহ্কে এবার রোকসানা সত্যি সত্যি অবাক করে দেবে। বলবে, তুমি তো বাইরে বাইরে থাক, বউ নিয়ে এসো, সে এখানে থাকবে, তুমি তোমার মতো সিনেমা করোগে হিলি দিল্লি।
মনটা আস্তে আস্তে প্রীত হয়ে এলো রোকসানার। কেউ জানলো না এ কথা, এত একান্তে। শুধু চেয়ারের বাজুতে চোখ–বোজা বেড়ালের বাচ্চার মত বা হাত তার শীতল হয়ে পড়ে রইলো।
হঠাৎ হাতটা ছিটকে পড়লো কোলের ওপর। জরিনার কামরা থেকে লাফিয়ে লাফিয়ে ওঠা সংগীতের আচমকা ধাক্কায় রোকসানার স্নায়ুগুলো যেন আর্তনাদ করে উঠলো।
জরিনা তার রেডিওগ্রামে আবার সেই রেকর্ড চাপিয়েছে যার শুরুতে ট্রাম্পেটের বিকট কয়েকটা খোঁচা। বেশ তো ছিল এতক্ষণ মেয়েটা ঘুমিয়ে। হঠাৎ এই বিশ্রী আওয়াজটাকে জীবন্ত করে তুলতে বলল কে তাকে? আর কী চড়া ভল্ম, যেন সব কিছু ডুবিয়ে ছাপিয়ে দিতে চায়, যেন বাড়িতে একটা ছোটখাটো রেডিওর দোকান খোলা হয়েছে।
সুর আসছে। চপল, বহুমুখী, তীব্র, ধাতব।
রোকসানা উঠে দাঁড়াল। এত জোরে না বাজালেই কি নয়?
হয়ত কানে হাত দিত রোকসানা, কিন্তু দিল না। সাদেক বললেন, কিছুটা নিরুত্তাপ কণ্ঠে, বোসো তুমি। না, বসবে কেন? আমাদের চা দিতে বলো। জরিনাও খাবে। আমি ওকে দেখছি।
.
আস্তে আস্তে জরিনা মাথা রাখলো বালিশে। দুহাত চুলের পেছনে রেখে, দুপা সমুখে ছড়িয়ে, সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে রইলো। শাড়ি উঠে এসেছে শুভ্ররক্তিম, চিতা বাঘের বুকের মত জানু অবধি। বৃষ্টি নেমেছিল দুপুরে। একটু ঠাণ্ডা করছে বৃষ্টি–শেষের বাতাসে। তা করুক।
আলীচাচা বলেন, হৃদয়কে যা স্পর্শ করে একমাত্র তা–ই সত্য।
একটু আগেই কবিতা লিখতে চেষ্টা করেছিল জরিনা। একটি সুন্দর সনেট। কিন্তু হলো না। বদলে আলীচাচার মুখ ভেন্টিলেটর থেকে উপুড় হয়ে পড়া আলোর মতো তার দুচোখ জুড়ে রইলো। তার সমস্ত কবিতা যেন তার অজান্তেই একটি মাত্র পাঠকের জন্য গড়ে ওঠে; অক্ষর হয়, হয়ে এসেছে, এই এতকাল, তার পনেরো বছর বয়স থেকে, যেদিন থেকে সে কবিতা লিখতে শুরু করে–আলী চাচার জন্যে।
ঠিক এমনি মুহূর্তগুলোয় আর কাউকে তার মনে পড়ে না।
আর মাকে তার মনে পড়ে, যে–মার কথা মনে করলে কথা কয়ে ওঠেন, যে মার মুখ শুধু কাঠ পুতুলের মতো নয়, যে মা মাথার নীল রিবন বেঁধে দেন মনে করলেই সেই মাকে মনে পড়ে।
আলীচাচার নাম কবে যে পর্দায় দেখতে পাবে জরিনা! শহরের সবচেয়ে অভিজাত শো হাউস; ঠিক দুপুর রোদে কিশোরী মুখের মত সবুজ তেতে ওঠা, লম্বা কাঁচের প্যানেল আর মানুষের পোশাকের ভিড়–একটা ছবির মতো তার চোখের সমুখে ভেসে ওঠে। ভেতরে আলো নিবলো মিষ্টি ঘণ্টা পড়বার সঙ্গে সঙ্গে। আর অন্ধকার। আর সুবাস। চোখ সয়ে এলে পর মানুষ। ততক্ষণে পর্দায় ভেসে উঠেছে রচনা ও পরিচালনা–আলীজাহ্। তারপর নিবে যাওয়ার আগে, আসন্ন ছবির শুরুতে, আগুনের মতো একবার জ্বলে উঠে–সেই নাম মিলিয়ে গেল।
আলীচাচা বলেছিলেন, আমার ছবির শুরুতে, একেবারে প্রথমে, বইয়ের নামেরও আগে কবিতার একটা লাইন ভেসে উঠবে পর্দায়। কার কবিতা জানিস?
কার?
তোর।
আমার? আমার!
বিস্ময়ে প্রায় আর্তনাদের মত শুনিয়েছিল জরিনার কণ্ঠস্বর।
হ্যাঁ, তোর মানে, সেবার আমাকে কতগুলো কবিতা দিয়েছিলি ইংরেজিতে লেখা, হারে, ইংরেজিতে লিখিস কেন? বাংলায় লিখতে পারিস না? বাংলায় লিখবি।
জরিনা যেন নিবে যায়। বলে, তাই তো লিখি। শুধু কখনও ইংরেজিতে। তোমরা মনে কর আমি বুঝি বাংলায় লিখতে জানি না।
তা কেন? তোর সেই ছোটবেলায় লেখা বিচ্ছিরি রকমের অদ্ভুত চিঠিগুলোর কথা আমার মনে আছে। আমার চেয়েও ভালো বাংলা লিখিস তুই সেই তখন থেকেই।
জরিনা একটু বিব্রত হয় যেন চিঠির প্রসঙ্গে। চটপট মুখ সুঁচালো করে বলে, আমার কোন কবিতা নিয়েছ তাই বলো।
আলীজাহ্ তার সুগন্ধ সিগারেটে টান দেয়।
তোর সেই কবিতা–A Torso I am এর প্রথম দুটো লাইন।
আমার মনে নেই।
আমার আছে।
আলীচাচা তখন তর্জনী তুলে শূন্যে একটা সরল রেখা এ মাথা থেকে ও মাথা অবধি টানতে টানতে বলেছিলেন,
ফেড ইন করছে–দ্যাখ–
Beneath the black sun
We shall rise in a flame
তার কণ্ঠ এত গভীর আর আবৃত্তি এত সুন্দর যে জরিনার মনে হয়েছিল এ দুটো লাইন সে কোনকালে লেখেনি। যেন পৃথিবীর অন্তস্থল থেকে এক যথার্থ কবি কোন এক মঙ্গলমুহূর্তে উচ্চারণ করেছিল এই দুটো লাইন, আব তা জীবনকাল, জীবনকে অতিক্রম করে অনন্তকালের মত শুদ্ধ এবং সত্য হয়ে আছে আলীজাহ্ উজ্জ্বল আত্মায়।
আলীজাহ্ আবৃত্তির সঙ্গে সঙ্গে জরিনার চোখে তৈলচিত্রের মতো একটা ছবির জন্ম নিয়েছিল সেদিন। বিশাল কোবাল্ট নীলের দিগন্তজোড়া ক্যানভাসে কার এক অদৃশ্য আঙ্গুল যেন দীর্ঘ অথচ সরু সোনালি তরঙ্গ এঁকে গেল। তখন তার বয়স মোল…Beneath The Black Sun.. কী সে ভেবেছিল সেই ষোল বছর বয়সে : এখন, এই মুহূর্তেও সেই ভাবনা তার ভাল লাগলো একটা ব্যথার মত… We Shall Rise… সে আর আলীচাচা…সোনালি তরঙ্গ…In A Flame… যদি তা সত্যি হতো।