কিন্তু পরিহাসটুকু ধরতে পারল না রোকসানা। বুঝতে পারার মতো ক্ষমতা নেই একথা বললে ভুল হবে। আসলে আগ্রহ নেই।
একেক সময়ে সাদেকের মনে হয়েছে, যেহেতু জরিনার মা তার কর্মজীবনের জন্য অমন অবশ্যম্ভাবী ছিলেন তাই হয়ত রোকসানা বিপরীত বিন্দুতে তার নিজের স্থান বেছে নিয়েছে। আর এ ধারণার জন্যই খুব কম, প্রায় একেবারেই না, তিনি রোকসানার সঙ্গে তার কর্মজীবন নিয়ে আলোচনা করতেন।
রোকসানার নিস্পৃহতা চোখ এড়ালো না সাদেকের। আরো স্পষ্ট হলো রোকসানা যখন ভিন্ন প্রসঙ্গ পাড়লো।
ইস, যা বিষ্টি নেবেছিল। ভাবলাম রাত অবধি চলবে বুঝি। শীতের মুখে কিন্তু হঠাৎ অমন একদিন পাগলা বিষ্টি নাবে।
হ্যাঁ, আমারো তাই ভাবনা হচ্ছিল। ভালো কথা, আলীজাহ্ সন্ধ্যের প্লেনে আসছে।
কই, শুনিনি তো। তাই নাকি?
চেয়ারে নড়েচড়ে বসলো রোকসানা।
এই তো খানিক আগে তার এলো। বলতে মনে নেই।
তা বলা নেই কওয়া নেই, হঠাৎ যে?
হঠাৎ আবার কোথায়? ও তো ওমনিই। টাকার দরকার পড়েছে হয়ত।
তা–ই হবে। হাসলেন শাহ সাদেক আলী। ওর তো ধারণা আমার বিরাট টাকা, হাত পাতলেই হলো। তা যদ্দিন থাকে নিক না।
শেষের কথাটা ইচ্ছে করেই বললেন সাদেক। কেননা তিনি জানেন, আলীজাহ্ যে লাহোর থেকে এসে এমনি করে হাত পাতে তা রোকসানার পছন্দ নয়। কোনদিন রোকসানার মুখোমুখি আলীজাহ্ টাকা নেয়নি, সাদেক দেননি–তবু রোকসানা জানে। আর জানে বলেই তিনি তা লুকোন নি কোনদিন।
আর লুকোবেনই বা কেন? আলীজাহ্কে তিনি ভালোবাসেন শুধু সহোদরের মতো নয়, সন্তানের মতোও। দুজনের বয়সের দূরত্ব কুড়ি বছরের মতো হলেও মনের দিক থেকে বুঝি আলীজাহ্ সাদেকের সবচেয়ে কাছাকাছি।
মনে আছে কলকাতার কথা। সাদেক তখন প্র্যাকটিস করছেন, রাজনীতি করছেন আর আলীজাহ্ কলেজে নতুন উঠেছে। সাদেক চেয়েছিলেন আলীজাহ্ ডাক্তার হবে। কিন্তু ছোটবেলা থেকে যার আবদার তিনি শুনে এসেছেন উদার জনকের মতো, এ ক্ষেত্রেই বা তার ব্যতিক্রম হবে কেন?
আলীজাহ্ বললেন, আর্টস পড়ব লেখক হবো। সাদেক বললেন, বেশ তো। লেখকরাও মানুষের ডাক্তার বৈকি। আমার ইচ্ছাটা কিন্তু একদিক থেকে অপূর্ণ রইলো না।
শেষ অবধি পড়াটাও ঠিক মতো হয়নি আলীজাহ্। তবু সাদেক কিছু বলেননি। বি.এ. পরীক্ষার রাতে দরোজায় খিল তুলে আলীজাহ্ হ্যাঁমলেটের পাঠ রিহার্সেল করছিল–পরদিন বেতারে অভিনয় করতে হবে। আড়াল থেকে চুপ করে দেখে নিঃশব্দে সরে এসেছেন সাদেক। কেবল বুঝতে পারেননি, লেখক হবার আকাক্ষা যার সে কেন অভিনয় নিয়ে এমন করে, এমনকি এই পরীক্ষার রাতেও মাথা ঘামাবে? বরং তিনি ক্ষুণ্ণই হয়েছিলেন মনে মনে। শাহ সাদেক আলী একটি মাত্র জীবনকালে একটি লক্ষ্যেরই সমর্থক, সে লক্ষ্যে যা কিছুই হোক না কেন। কই, সুযোগ তো এসেছিল অনেক, কিন্তু তিনি দশের উন্নতি আর নিজের উন্নতি একসঙ্গে কখনোই প্রার্থনা করেননি।
আলীজাহ্ বি.এ পরীক্ষা দেয়া হলো না, অভিনেতা হতে পারল না, লেখক হতে পারল না। হতে পারল না নয়; কী যে হলো তার, কিছুইতে মনের স্থিরতা এলো না অনেকদিন; কোথা থেকে অকারণে যে একটা বাতাস এলো– বিক্ষিপ্ত হয়ে গেলো ভাবনা, আচ্ছন্ন হয়ে রইলো। আকাক্ষা। এমনি করে তিন বছর। এমন কি বাসাতেও আলীজাহ্ নিয়মিত ফিরত না খেতে ঘুমোত না। তবু সাদেক কিছু বলেননি; আলীজাহ্ প্রতিভায় তার অগাধ বিশ্বাসকে কোনদিন এতটুকু ক্ষুণ্ণ হতে দেননি।
অবশেষে একদিন নিতান্তই আকস্মিকভাবে আলীজাহ্ তার লক্ষ্য বেছে নিল চলচ্চিত্র। বলতে গেলে গোটা পরিবারে এ এমন একটা বিদ্রোহী সংকল্প যা প্রথমে সাদেককেও চিন্তাকুল করে তুলেছিল। কিন্তু মুখে তিনি কখনোই তা জানতে দেননি। বরং বম্বেতে প্রথম কাজ যখন সে পেল তখন সাদেকই খুশি হয়েছিলেন সকলের চেয়ে বেশি। আর সেই চরম খুশির প্রকাশটা ছিল, আলীজাহ্ যখন বম্বে থেকে গ্রেট পেনিনসুলারে এসে সকালে নাবলো হাওড়ায়, সাদেক নিজে তাকে গাড়ি করে আনতে গিয়েছিলেন।
তবু প্রতিষ্ঠা এলো না আলীজাহ্। দেশ বিভাগের পর গেল লাহোরে। সেখানেও না। অর্থের জন্য বেনামে চিত্রনাট্য লিখতে পারে আলীজাহ্ কেননা অর্থের অনেক দোষের মধ্যে একটা বড় গুণ, ওটা বেঁচে থাকার জন্য জরুরি। শস্তা ছবির শিরোনামায় আলীজাহ্ নিজ নাম কী করে যুক্ত হতে দেবে? শিল্পমাধ্যম যদি শিল্পকেই অস্বীকার করলো, তাহলে এখানে আলীজাহ্ কেন? তাই আজ অবধি রচয়িতা–পরিচালক হবার, ভালো ছবি করার ইচ্ছে তার রয়ে গেছে অপূর্ণ।
আর কেউ বুঝুক আর না বুঝুক, এটা সব চেয়ে ভালো করে বোঝেন শাহ সাদেক আলী। তাই তার স্নেহের উৎস আলীজাহ্ জন্যে আজো নির্মল, স্রোতস্বিনী।
পক্ষান্তরে এটা রোকসানার একটা গোপন মর্মপীড়া। কিন্তু কোন কালেই সাহস করে উচ্চকণ্ঠে কিছু বলা হয়নি। এবং আর দশটা কারণের মধ্যে এটাও একটা কারণ যে, তাতে সাদেক আহত হবেন।
সাদেক বললেন, চা দেবে না?
রোকসানা মুখে বলল, দিচ্ছি।
কিন্তু মনটা পড়ে রইলো আলীজাহ্ দিকে। আলীজাহ্ আসছে। এবারো সেই পুরনো ব্যর্থতার গল্প অমিত উপহাস মেশানো কণ্ঠে–দুদিন কী তিনদিন। তারপর সে চলে যাবে। না, এবার আলীজাহ্কে এত তাড়াতাড়ি যেতে দেবে না রোকসানা। নতুন বাড়ি হয়েছে। তাকে দেখাতে নিয়ে যাবে রোকসানা। অনেক পরামর্শ আছে সাজানো গোছানোর ব্যাপারে। জরিনার সঙ্গে হয়ত এ নিয়ে কথা বলা যেত, কিন্তু যখনি বলতে গেছে, প্রতি মুহূর্তে মনে হয়েছে তার, জরিনা হেসে উঠবে–যে হাসি গিয়ে বিধবে তার মর্মমূলে। মনে হয়েছে, জরিনা সংসারের এইসব খুঁটিনাটিকে উপহাস করে নিজ সত্তাকে নিশানের মত উঁচু আর ভাবনাহীন করে রাখতে পারে। না, জরিন থাক তার নিজেকে নিয়ে; আলীজাহ্কে তার এখন সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। আসছে, ভালোই হলো।