জরিনা চোখ বুজে মনে মনে কৃতজ্ঞতা জানাল আলীজাহ্কে। কত সহজে আলীজাহ্ বুঝতে পাবলো। প্রয়োজন হলো না কোনো ব্যাখ্যার, কোনো বর্ণনার।
ঘুম পাচ্ছে তোর?
হ্যাঁ। চোখ মেলল জরিনা। ভাবছিলাম।
না, ঘুমো তুই।
উঠে দাঁড়াল আলীজাহ্। জরিনা বলল, শুনবে না আলীচাচা কী ভাবছিলাম?
বল।
ভাবছিলাম, কাউকে আমার দরকার নেই। যদি কাউকে দিতে হয় নিজেকে তো এমন একজনকে দেব, যে ভালোবাসার কিসসু বোঝে না, জানে না।
হাসলো আলীজাহ্। বলল, মানে, যে ভদ্রলোক তরকারিতে পরিমাণ মতো নুন পেলেই খুশি হবে?
হ্যাঁ। রসিকতাটুকু জরিনার ভেতেরই সংক্রামিত হয়ে গেল যেন। হাসতে হাসতে সে যোগ করল, আর তা না পেলে যে আমার চুলের মুঠো ধরে নাজেহাল করবে। তাতে অনেক সুবিধে। তাতে মনটা থাকবে আমার আমার মতো যারা তাদের জন্যে।
আলীজা চুপ করে ভাবলো খানিক। একটু আগে যে হালকা হাসির রেখা মুখে ছিল তা বিলীন হয়ে গেল। জরিনার দিকে তাকিয়ে বলল, আমি বুঝতে পারছি সব। মানুষ আসলে স্বর্গের মতো হতে চায়, কিন্তু পারে না। তাই কিছুদূর যাবার পর বড় বিশ্রী পতন ঘটে। তা নিয়ে দুঃখ করবি কেন?
আর করি না। এখন ভালো হয়ে গেছি। কাউকে লাগবে না আমার। বলতে বলতে আলীজাহ্কে জড়িয়ে ধরে হঠাৎ কেঁদে ওঠে জরিনা। সে–কী কুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না।
আলীজাহ্ তখন তার মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। মুখটাকে দুহাতের ভেতরে নিয়ে কপালে ঠোঁটের স্পর্শ চন্দনের মতো প্রলেপ করে দেয়। বলে, লক্ষ্মী সোনা কী হলো তোর? পারবি, তুই পারবি, কেন পারবি না? শোন–শোন–দ্যাখ।
আলীজাহ্ তাকে অনেকক্ষণ ধরে সান্ত্বনা দিতে থাকে। নিজের জন্যও যেন সান্ত্বনা মিলছে তার এমনি করে। দুজনের ভেতরে কখন কী ভাবে একটা সুন্দর সেতু গড়ে ওঠে। জরিনার তখন পরম নিশ্চিন্ত নিরাকুল ঘুম পায়। আলীজাহ্ তখন স্থাকে বিছানায় শুইয়ে বাতিটা নিবিয়ে দিয়ে চলে যায়।
.
ঘুম আসে না শাহ সাদেক আলীর।
পাশে রোকসানা শুয়ে অকাতরে ঘুমোচ্ছে। তার মুখোনার দিকে তাকিয়ে আজ আবার জরিনার মায়ের কথা মনে পড়ে তার। কেমন ছিল দেখতে? চোখ বুজে সাদেক ভাবতে চেষ্টা করেন। নাহ্, বয়সের সঙ্গে সঙ্গে স্মৃতিও ঝাঁপসা হয়ে আসছে। কিছুতেই স্পষ্ট করে মনে পড়ে না। বিছানায় শুয়ে শুয়ে কেবলি এপাশ ওপাশ করতে থাকেন তিনি। নাহ, তবু কিছু না। শুধু বেদনার মতো একটা অনুভব। তিনি আজ বড় অভাববোধ করলেন জরিনার মার।
রোকসানা চোখ মেলে সাদেকের কপালে হাত রাখে। ঘুম জড়ানো গলায় শুধোয়, ঘুমোননি?
তুমি ঘুমোও।
রোকসানা তখন আধো উঠে বসে।
আহ উঠলে কেন?
রোকসানা তবু শুয়ে পড়ে না। তখন সাদেক চাপা কণ্ঠে তিরস্কার করেন, কী হলো তোমার?
কিন্তু পরক্ষণেই মমতা ঝাঁপিয়ে পড়ে বুকে। রোকসানার বাহু আকর্ষণ করে শুইয়ে দেন। বলেন, এমনিতে ঘুম ভেঙে গেছে হঠাৎ। তুমি ঘুমোও।
তাঁর কণ্ঠের কোমলতা রোকসানাকে আবার ঘুমের ভেতর নিয়ে যায়। আবার সেই ভাবনাগুলো ফিরে ফিরে আসতে থাকে নিশাচর প্রাণীর মতো পায়ে পায়ে, নিঃশব্দে, তার চারদিকে।
আলীজাহ্ ঠিকই বলেছে, কোথায় গেল আমার সংগ্রাম? অতিথিদের সঙ্গে দুঃখ করা আর বিবৃতি লেখা পর্যন্তই আজ আমার সংগ্রামের দৌড়।
ধিক্কারে ভরে ওঠে মন। ক্ষমা নেই।
আমার ক্ষমা নেই। যে সাহস আমার নিজেরই নেই সে সাহস আমি আরেকজনকে দেব কী করে? লক্ষ্য থেকে আমি নিজেই দূরে, আমি লক্ষ্যের দিকে আলীকে ফেরাবো কী করে? রসুলুল্লাহর সেই কথাটা মনে পড়ল শাহ সাদেক আলীর। নিজে যা অনুসরণ করো না, করতে পারো না–অন্যকে তা অনুসরণ করতে বোলা না।
মনে মনে দরুদ পড়লেন তিনি।
আজ সারা দুপুর ধরে খাদ্য সমস্যার ওপর দীর্ঘ একটা বিবৃতি লিখেছেন। লিখেছেন, কেটেছেন, বাক্যকে আরো শাণিত করে তুলেছেন একেকটা সংশোধনের ভেতর দিয়ে। কই, তখন তো তার মনে হয়নি অসার, অন্তঃসারশূন্য, শাক্তহীন কতগুলো চমক লাগানো কথা তিনি সাজিয়ে যাচ্ছেন?
আলীজাহ্ ঔদ্ধত্যকে আর ঔদ্ধত্য বলে ভাবতে পারছেন না তিনি। ভয় করছেন তার বদলে।
শেষ প্রশ্নের কী জবাব দেব আমি?
নিঃশব্দে বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন সাদেক। বসলেন চেয়ারে। টেবিলের ওপর পানি রাখা ছিল। পানি দেখে তৃষ্ণা পেল তার। হাত বাড়িয়ে শিশুর মতো অনেকখানি পানি খেলেন।
যখন আমি প্রথম রাজনীতিতে নামলাম, তখন আমার পাওনার হিসেব ছিল না। মন্ত্রিত্বের স্বপ্ন ছিল না। প্রয়োজন ছিল না কোনো ক্ষমতার–আজ যার একটাও নেই বলে আমি মনে করছি কাজ করব কী করে?
কেন, যে করে আমার যৌবন থেকে কাজ করে এসেছি। তখন কোনো কিছুর আশা না করেই কাজ করেছি। আজ দেশে সামরিক শাসন চলছে, মানুষের বুক ভেঙ্গে যাচ্ছে, আজো আমার জন্য কাজ করবার আছে। আমার পার্টি ক্ষমতায় নেই বলে কি আমার সব শক্তিও চলে গেছে?
শাহ সাদেক আলী আত্মার ভেতরে ডাক শুনতে পেলেন–এসো, বেরিয়ে এসো। শাহ সাদেক আলী টেবিলের ওপরে ফাইলের ভেতর থেকে বিবৃতিটা বের করে টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে ফেললেন।
আবার আমি শহর থেকে শহরে, গ্রাম থেকে গ্রামে, মানুষকে দীক্ষা দেব–ঐশ্বর্যে ভরে ওঠার দীক্ষা, সাহসের শিক্ষা, অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়াবার সঙ্কল্প।
রক্তের ভেতরে তারুণ্যের জোয়ার ওঠে তাঁর।
আলীজাহ্কে তখন আরো আপন মনে হয়। হঠাৎ বুকের ভেতরে মোচড় ওঠে তার।