.
খাবার টেবিলে এলো না আলীজাহ্। তার ঘরে খাবার পাঠিয়ে দিয়েছিল রোকসানা, সেটাও পড়ে রইলো।
জরিনা এলো রাত এগারোটা তখন। জরিনাকে ফটক পেরিয়ে আলো অন্ধকারের ভেতর দিয়ে আসতে দেখে আলীজাহ্ প্রসন্ন হয়ে উঠলো মনে মনে। এতক্ষণে যেন সে অনুভব করতে পারল, সত্যি সত্যি সে ঢাকা এসেছে।
সিঁড়ির শেষ ধাপে এসে আলীজাহ্ জরিনার কাঁধে হাত রাখল, বলল, টমবয় হয়েছিস, না? এত রাত করে আড্ডা মারতে শিখেছিস।
জরিনা কিছু বলল না। চোখ মাটির দিকে রেখে মাথা নাড়লো, যেন স্প্রিং দেয়া পুতুল। আলীজাহ্ শুধালো, ঘুম পাচ্ছে?
হুঁ।
চল তোর ঘরে। এয়ারপোর্টে যাসনি যে আজ?
জরিনার ঘরের দিকে যেতে যেতে পরিহাস কণ্ঠে আলীজাহ্ উচ্চারণ করল। ঘণ্টা কয়েক আগে যে সে বিশ্রী একটা দৃশ্য করেছে, তার লেশমাত্র এখন তার ভেতরে খুঁজে পাওয়া যাবে না।
ঘরে এসে বিছানার ওপর ধপ করে বসে পড়ল জরিনা। তারপর হেসে ফেলল। সুন্দর, বিলম্বিত হাসি।
এলে তুমি আলীচাচা। আমি মনে করলাম, তুমি বুঝি আসবেই না।
ঠাট্টা করেছি তাহলে টেলিগ্রাম করে?
হুঁ–উ। নইলে আমার মনে হলো কেন আসবে না?
আলীজাহ্ও হেসে ফেলল তার কথা বলবার ধরন দেখে। আদুরে একটা ছোট্ট মেয়ের মতো পা দোলাতে দোলাতে গলায় টান তুলে কথা বলা হরিনাকে তার ভীষণ ভালো লাগল।
ছিলি কোথায়?
কোথায় ছিলাম? এক, বিকেলে নতুন বাড়িতে। খুব বিষ্টি হয়েছিল। তারপর। গিয়ে দেখি সোলেমান সাহেব মেঝেয় পড়ে নাক ডাকিয়ে ঘুমোচ্ছে। কাজে ফাঁকি–বুঝলে?
কে?
নতুন বাড়ি সাজানোর জন্যে যে ভদ্রলোক। মজার কাজ।
ও–হো। তারপর?
খুব বকুনি দিলাম! ফ্যালফ্যাল করে তখন, জানো, আমার দিকে তাকিয়ে রইলো। যেন আমাকে চিনতেই পারছে না।
ফাজলামো রাখ।
বেশ।
গম্ভীর হয়ে গেল জরিনা! তার পর আবার সেই হাসিতে ভেঙ্গে পড়া।
তারপর সেখান থেকে ব্রিটিশ কাউন্সিলে গিয়ে বই পড়লাম। খুব শক্ত বই। কী যেন নাম?
বাজে কথা!
সত্যি।
তারপর বেরিয়ে–কী করলাম। বেরিয়ে কী করলাম যেন?
জরিনা মাথা কাত করে তেরচা চোখে ভাবতে চেষ্টা করল। এ ভঙ্গিটা আলীজাহ্ খুব চেনা। ভঙ্গিটি যেন আরো আপনার একটা ঝির সৃষ্টি করলো তার ভেতরে।
হ্যাঁ, সিনেমা দেখতে গেলাম। দেখতে দেখতে মনে হলো আজ না তুমি আসছো, এতক্ষণ এসে গেছ?
আলীজাহ্ হঠাৎ তার কাঁধ ধরে ঝাঁকুনি দিয়ে বিস্মিত কণ্ঠে বলল, তুই ড্রিংক করেছিস?
না, না।
রিনু।
আলীজাহ্ অবাক চোখে তাকাল জরিনার দিকে। কাঁধ থেকে হাত সরিয়ে নিয়ে কপালে রেখে শুধালো, কতটা খেয়েছিস?
অল্প একটু।
ছি, ছি। কেন খেয়েছিস? রোজ খাস।
না।
কে শেখালো?
কেউ না।
তবে?
শুধু আজ। এই একটু। এক্সপেরিমেন্ট করলাম। লোকে বলে না ড্রিংক করলে দুঃখ থাকে না? তোমাদের শরত্যাবু একটা মিথ্যুক। নইলে আমার আরো কান্না পেল কেন?
আলীজাহ্ তাকে শুইয়ে দেবার চেষ্টা করলো। কিন্তু শোবে না জরিনা।
ইস এত বিশ্রী লাগছে আমার। আমাকে এক্ষুণি সারিয়ে দিতে পারো না। আমি এখন চিৎকার করব কিন্তু।
চুপ, চুপ।
তখন আলীজাহ্ ওকে বাথরুমে নিয়ে মাথায় পানি ঢেলে দিল অনেকক্ষণ ধরে। বলল, গা ছুঁয়ে বল, আর কখনো খাবিনে। তুই যে একটা কী হয়েছিস?
বকছ কেন?
মাথায় পানি ঢালবার পর কিছুটা ভালো লাগে জরিনার। নিজেই তখন তোয়ালে দিয়ে মাথা মুছতে থাকে। আর আলীজাহ্ তাকে নতুন করে নতুন চোখে দেখে। নিজের সঙ্গে একটা অলক্ষিতের মিল খুঁজে পায় যেন। মনে হয়, তারই একটা অংশ কোন জন্মান্তরে বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল, আজ আবার ফিরে এসেছে।
কী আশ্চর্য, জরিনারও তখন এই কথাটা মনে হচ্ছিল। আলীজাহ্ এই মাণিকের মতো চোখের তারা দুটো মাঝে মাঝে কোন এক অজানা দীপ্তির স্পর্শে এমনি বিচ্ছুরিত হয়। মনে পড়ে তার। শিথিল নদীর একটা ঠাণ্ডা স্রোতের মতো শিথিলতা ছড়িয়ে পড়ল তখন জরিনার শরীরে। মনে মনে উচ্চারণ করল– আলীচাচা।
ব্যক্তিগত, শুভ্র, দীপ্ত একটা শিখার মতো আলীজাকে মনে হয় তার। তীব্র একটা টান জেগে ওঠে বুকের ভেতরে। কোন এক অজ্ঞাত অপরাধের কারণে একই আত্মাকে আল্লাহ দুটো শরীরে বন্দি করে রাখলেন?–ভাবতে ভাবতে একটা অদ্ভুত একাগ্রতার ভেতরে ডুবে গেল জরিনা।
আলীজাহ্ জরিনাকে বলল, কাছে আয়। বোস।
জরিনা বসলো। বলল, সামান্য একটু খেয়েছি তাই এত মাশুল দিতে হচ্ছে।
খাসনে– কখনো খাসনে। আজ আমাকে খুব চমকে দিয়েছিস তুই। আমি না এলে কী হতো বলত?
কী হতো আর? বাবা বিশ্বাস করতেন না। আর বাবার স্ত্রী উঠে পড়ে লাগতেন তাকে বিশ্বাস করাবার জন্যে।
দূর পাগলি।
জরিনা ঝুঁকে পড়ল আলীজার দিকে। বলল, বেঁচে থাকতে হলে, ঘৃণার সঙ্গে আপোস করতে হয়, আলীচাচা?
কেন করবি? তুই করতে পারবি না।
করতে পারলাম না। কিন্তু দুঃখ হয় যে?
হোক। তাই বুঝি মদ গিলতে গিছলি?
জরিনা হেসে ফেলে। বলে, ভুলতে পারছ না। খুব শাসন করতে ইচ্ছে করছে আমাকে? করো আলীচাচা। আমি খুব খারাপ হয়ে গেছি।
তোর আজ মতিভ্রম হয়েছে। আজ তুই আবার কথা বললে মার দেব।
কিছুক্ষণ চুপ করে বইলো দুজনেই। পরে আলীজাহ্ প্রায় ফিসফিস করে শুধালো, মাসুদ লেখে না?
ইতরটার কথা মনে করিয়ে দিও না তো।
কেন?
গভীর দুচোখে জরিনার মুখের দিকে তাকাল আলীজাহ্। আস্তে আস্তে শুধোল, তুই ঠিক বুঝতে পেরেছিস?
হ্যাঁ।
জানতাম। তুই একা থাকবার ভাগ্য নিয়ে এসেছিস।