বলেই সে উৎসুক চোখে সস্মিত মুখে তাকাল আলীজাহ্ দিকে। কিন্তু আলীজাহ্ তার জন্য কিছু বলতে পারার আগেই সাদেক প্রশ্ন করলেন, তোমার ছবি কি শেষ হয়ে গেল?
তখন ঋজু হয়ে বসলো আলীজাহ্। নিঃশেষে চুমুক দিয়ে শরবতের গ্লাশটা নাবিয়ে রাখল টিপয়ে। বলল, না। আমি করছি না। আমি আর ছবি করবে না।
বলেই সে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল কাউকে কোন কথা বলবার সুযোগ না দিয়ে, পেছনে পাথরের মতো দুটো স্তব্ধ মুখ রেখে, বারান্দায়।
আলীজাহ্ এ অসৌজন্যতা একেবারেই আকস্মিক।
.
তখন থমথম করতে লাগল সারাটা বাড়ি। শাহ সাদেক আলীর মন ভীষণ রকমে বিক্ষিপ্ত, বিস্মিত হয়ে রইলো। রোকসানা না বসতে পারলো তার কাছে, না যেতে পারল আলীজাহ্ কাছে। তার মনে হলো, এক মুহূর্তে দুভাই তার কাছ থেকে অনেক দূরে সরে গেছে। দুভাইয়ের ভেতর এমন একটা ভাবের বিনিময় হয়ে গেছে, যেখানে সে নিতান্তই বাইরের। তার ভয় করতে লাগল। শোবার ঘরে এসে তখন চুপচাপ বসে রইলো রোকসানা।
শাহ সাদেক আলী স্থাণু হয়ে রইলেন অনেকক্ষণ। অনেক ঝড়ের সম্মুখীন হয়েছেন তিনি, কিন্তু কোনদিন এতটা দোলা লাগেনি তাঁর আত্মায়। সারাটা জীবনে যে রকমটি দেখা যায়নি তাকে, আজ তাই প্রত্যক্ষ করা গেল। বিব্রত হয়ে, বিচলিত হয়ে, স্পষ্ট রকমে নিজের ব্যাকুলতাকে প্রকাশ করে তিনি আলীজাহ্ কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন।
বারান্দার অস্পষ্ট আলোতে দাঁড়িয়ে আছে আলীজাহ্। তার ঈষৎ আনত মুখ, টান টান মেরুদণ্ড আর রেলিংয়ে প্রসারিত দুই বাহু– সব মিলিয়ে একটা অচেনার আভাস সৃষ্টি হয়েছে। মনের চঞ্চলতাকে দমন করে শাহ সাদেক আলী কণ্ঠে আওয়াজ তুললেন, আলী আমার সঙ্গে এসো।
ঘরের ভেতরে আবার দুজনে মুখোমুখি বসলো। আলীজাহ্ চোখের ভেতরে বহুক্ষণ দৃষ্টি রেখে সাদেক যেন সম্মোহিত করলেন তাকে। বললেন, ওভাবে উঠে যাওয়াটা আমি পছন্দ করিনি।
তখন ছবি বন্ধ হয়ে যাওয়ার সবটুকু ইতিহাস সবিস্তারে শুনলেন সাদেক। শুধদলেন, তা এখন কী করবে ঠিক করেছ? কিছুই না।
এটা হলো অভিমান। সমস্যার সমাধান তো হলো না।
চাইনে আমি।
তাহলে এত লড়াই করলে, সব কি মিথ্যে ছিল?
উত্তরে সাদেকের দিকে বড় সরাসরি তাকাল আলীজাহ্। এমন করে কোনদিন তাকে তাকাতে দেখেননি তিনি। আলীজাহ্ বলল, অল কোশ্চেন আর ডেড টু মি নাও।
বাংলায় বলো, তিরস্কার করলেন শাহ সাদেক আলী। রূঢ় শোনাল হয়ত কিন্তু ওকে সাহস দিতে হবে আমার, বন্ধুর পথে চলার দীক্ষা দিতে হবে–মনে মনে বললেন তিনি। তারপর কণ্ঠে যতটুকু সম্ভব মমতা মাখিয়ে বললেন, লক্ষ্য থেকে যারা সরে যায় তাদের আমি ঘৃণা করি। লড়াই করতে যারা ভয় পায়, হাত পা গুটিয়ে আনে, তাদের মরে যেতে বলি। একটা দেশের কথা ধরো, একটা জাতির কথা ধরো, একটা মানুষের কথা ধরো–সবার জন্যে যে জীবন দিয়েছেন আল্লাহ, তার মূল্য কি তোমার ভয়, তোমার অভিশাপ দিয়ে মাপা হবে। জীবন একটা মহৎ শক্তির নাম। জীবনের সার্থকতা সংগ্রামে। যে মুহূর্তে তুমি সগ্রাম থেকে হটে গেলে সে মুহূর্তে জীবন থেকেও বঞ্চিত হলে তুমি।
উত্তেজনায় থরথর করে কাঁপছিলেন সাদেক। চেয়ারের হাতলে বাঘের থাবার মতো পাঁচটা আঙুল দৃঢ় হয়ে উঠেছে। কপালে দেখা দিয়েছে বিন্দু বিন্দু ঘাম। আলীজাহ্ প্রায় চিৎকার করে উঠলো, জানি। আমি জানি।
কী! কী জানো তুমি?
ফাঁপা ফাঁপা এইসব কথার কী মূল্য?
স্তম্ভিত হয়ে গেলেন সাদেক। এই কি সেই আলীজাহ্ যাকে তিনি অমিত স্নেহে মানুষ করে তুলেছেন। এই চিৎকার করা, ক্ষুদ্ৰাত্মা, অজ্ঞান মানুষটা?
আলীজাহ্কে তখন যেন ভূতে পেয়েছে। উঠে দাঁড়িয়ে সে বলতে লাগল, কানাকড়ি দাম দেব না আমি আপনার কথার। আপনি নিজে কী করেছেন? কোথায় গেল আপনার সংগ্রাম? আপনার লক্ষ্যের জন্য নিষ্ঠা? নিজের দিকে তাকিয়ে দেখুন। বলুন আপনি নিজেকে এই কথাগুলো। কেন হাত গুটিয়ে বসে আছেন? মন্ত্রিত্ব যাবার পর, ইলেকশানে আপনাদের সেই জাতীয় পার্টি হেরে যাবার পর, দিস্তে দিস্তে অসার বিবৃতির বকুনি ছাড়া আর কী করেছেন আপনি? কোথায় আপনার আদর্শ? দেশের মানুষ আজ নীলামে যেতে বসেছে, আপনার সাধের পাকিস্তান তার রাজস্ব দিয়ে কতগুলো লোলুপ মানুষের বাড়ি গাড়ি ব্যাঙ্ক ব্যালেন্স জোগাচ্ছে, মন্ত্রিত্ব মানে আজ টাকা বানাবার গদি হয়েছে–আর আপনি ড্রইংরুমে বসে দুঃখ করছেন। অতিথিদের সঙ্গে আজ দুঃখ করা পর্যন্তই আপনার সংগ্রামের দৌড়। কেন আমাকে বলছেন এই কথাগুলো যা আপনার কাছেই মিথ্যে?
আলীজাহের কণ্ঠ কখন উঁচু পর্দায় গিয়ে পৌঁছেছে তা সে জানে না। রোকসানা ছুটে এলো এ ঘরে।
কী হয়েছে? কী হলো?
কিছু না। আলীজাহ্ চুপ করলো। চুপ করে বিসদৃশ রকমে দাঁড়িয়ে রইলো। হাতটা তখনো তার শূন্যে ঝুলছে, যা সে একটু আগেই তুলেছিল শাহ সাদেক আলীর দিকে।
রোকসানা তার দিকে তাকিয়ে দৃষ্টি ফেরাল সাদেকের দিকে। সাদেক তখনো একদৃষ্টে তাকিয়ে আছেন আলীজাহ্ দিকে। রোকসানার উপস্থিতি যেন তিনি অনুভবই করতে পারছেন না।
অনুতাপ হলো আলীজাহ্। সংম্বিৎ ফিরে পেলো সে। অনির্দিষ্ট চোখে একবার সাদেকের দিকে তাকাল। কিছু একটা বলতে চাইলো কিন্তু পারল না। বদলে, আস্তে আস্তে বেরিয়ে এলো। এত আস্তে যেন তার সমস্ত শক্তি অন্তর্হিত হয়ে গেছে।