এতদিন ছবি করিনি, তার ছিল জ্বালা। কিন্তু ছবি করতে করতে ফিরে আসা, নিজের সৃষ্টিকে কলঙ্কিত হবার জন্য তুলে দিয়ে আসতে বাধ্য হওয়া এবং কিছুই করতে না পারা–এ যন্ত্রণা মৃত্যুর, এর প্রাপ্তি অন্ধকার।
ছবি করতে করতে ছবির সঙ্গে তার হৃদস্পন্দন একতারে বাঁধা হয়ে গিয়েছিল। আজ তাই আর মমতা নেই নিজের ওপর। যত নিষ্ঠুরতা থাকতে পারে সব এখন ডেকে আনা চলে নিজেকে চূড়ান্ত রকমে পীড়িত করবার জন্য; নিজের জন্য যে কোনো অবহেলা যে কোনো ক্ষতি।
৬. শাহ সাদেক আলী বই পড়ছিলেন
শাহ সাদেক আলী বই পড়ছিলেন। বই রেখে বললেন, এসো, এসো।
আলীজাহ্ তার সম্মুখে বসলো। তখন সাদেক রোকসানাকে বললেন, ওকে কিছু খেতে টেতে দাও। এখানেই দাও। তারপর আলীজাহ্ দিকে তাকিয়ে, জরিনা সেই বিকেলে বেরিয়েছে। বলেছিলাম ওকে। যায়নি বুঝি এয়ারপোর্ট? তা তোমাকে এত ক্লান্ত দেখছি কেন, আলী?
শরীরটা বিশেষ ভালো নেই।
উদ্বিগ্ন হলেন সাদেক।
ডাক্তার করিয়েছো?
এমন কিছু নয়।
সাদেক বইয়ের পৃষ্ঠায় আবার কিছুক্ষণের জন্য মন দিলেন। কিন্তু চোখ থাকলেও মনটা সেখানে রইলো না। মন রইলো আলীজাহ্ দিকে –তারই সহোদরের দিকে, বাবার মৃত্যুর পর যাকে তিনি সন্তানের মতো মানু করেছেন, প্রশ্রয় দিয়েছেন, বাহু দিয়েছেন। শাহ সাদেক আলী কোন কিছুরই বাড়াবাড়ি পছন্দ করেন না –জরিনার মা সেটা বুঝতো–তাই হাজারো কষ্ট দিয়ে হাজারো জ্বালাতন করেও নিশ্চিন্ত নির্ভর থাকা যেত, যে, মানুষটা তাকে ভুল বুঝছে না। আর রোকসানা? রোকসানা কোনদিন মুখ ফুটে কিছু না বললেও সাদেক ইন্দ্রিয়বুদ্ধি দিয়ে প্রথম দিনেই জেনে গেছেন, এ হচ্ছে আলাদা জাতের মানুষ। এদের জন্য মমতা প্রকাশ না হলে ক্ষুণ্ণ হয়, অসহায় বোধ করে। তাই সাদেক যথাসম্ভব মাঝে মাঝে রোকসানাকে এ ক্ষুণতা থেকে, এ অসহায়ত্ব থেকে, নিজের মেজাজ অনুযায়ী মুক্তি দিতে চেয়েছেন। নতুন বাড়িটাও ঠিক এমনি একটা প্রকাশ। জরিনার মা হলে দরকারই পড়ত না হয়ত, কিংবা হয়ত সে নিজেই বাধা দিত। বলত–এত খরচ করে এটা না বানিয়ে, ছোটমোট একটা বাড়ি কর, তাতেই চলে যাবে। কিন্তু রোকসানা সেটা বুঝতো না। রোকসানাকে কিছুটা প্রীত করবার জ, তার জন্য তো সাদেক কিছুই করেননি হাতের সবকটা টাকা ঢেলে বাড়িটা বানিয়েছেন তিনি। কতটা কষ্ট হয়েছে তাঁর, সে কথা অনুক্তই রেখেছেন রোকসানার কাছে। আর এই যে তার সম্মুখে বসে থাকা আলীজাহ্ সে? সেও ঠিক জরিনার মায়ের দলের মানুষ যেন। তার জন্য নিজের গভীর মমতা বোঝাবার মতো চোখে দেখা যায় এমন কিছুই করতে হয় না। ইচ্ছে করলে তো তিনি মন্ত্রী থাকাকালে আলীজাহ্ জন্য অনেক কিছু করতে পারতেন– শুধু ব্যবসায়ী, লাখপতি, কোটিপতি কাউকে বলে দিলেই হতো। কিন্তু সেটা হতো তার ব্যক্তিগত জীবন আদর্শের মুখে কলঙ্ক মাখিয়ে–আলীজাহ্ এটা বুঝতে পারতো। তাই বছরের পর বছর কষ্ট করেছে, আর্থিক অনটনে নিরন্তর বিব্রত হয়েছে, কিন্তু ক্ষুণ্ণ হয়নি নাদেকের ওপর। নিজের বিবেক এবং কর্মকে কলুষিত না করতে পারার মহত্বটুকু আলীজাহ্ মনে প্রাণে বুঝতে পেরেছে। কিন্তু আলীজাহ্ তো এ রকম হবেই –শাহ সাদেক আলী মনে মনে এখন ভাবলেন—কারণ ও আমার ভাই। নিজের রক্তের ভেতরে আলীজার জন্য নতুন করে তীব্র একটা টান,একটা জোয়ার অনুভব করলেন শাহ সাদেক আলী।
রোকসানা তসতরিতে কিছু ফল কেটে আর নেবুর শরবৎ নিয়ে ফিরে এলো। এসে আলীজাহ্ সম্মুখে টিপয় টেনে সাজিয়ে রাখলেন। বলল, খান।
ভাই?
সাদেক বইয়ের ওপর চোখ রেখেই বললেন, তুমি খাও।
আলীজাহ্ খেতে শুরু করলে তিনি বই নাবিয়ে একজোড়া পূর্ণ চোখ স্থাপন করে তার খাওয়া দেখলেন। ঈষৎ উদ্বিগ্ন কন্ঠে শুধালেন, তোমার সব খবর ভালো তো, আলী?
উত্তরে আলীজাহ্ মাথায় ছোট্ট একটা ঝাঁকুনি দিয়ে কী বোঝাইতে চাইলো তা অস্পষ্টই রয়ে গেল। তাতে কিছুটা বিরক্তি বোধ করলেন শাহ সাদেক আলী। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে এত তাকে অপরের একেকটা এমনি অস্পষ্ট ভঙ্গি থেকে অর্থ উদ্ধার করতে হয়েছে যে পারিবারিক ক্ষেত্রে সেটা তিনি করতে রাজি নন। সেই বিরক্তিটা দমন করতে একটু সময় লাগলো। অবশেষে বললেন, মনে হচ্ছে শারীরিক কুশল। ঢাকায় কি কিছু কাজ ছিল?
না।
তাহলে আর কী কারণ থাকতে পারে?–শাহ সাদেক আলী চোখ তীক্ষ্ণ করে তার মুখ দেখে কারণটা অনুমান করতে লাগলেন। পরিবারের জন্য মায়া আছে তার, কিন্তু আলীজাহ্ কখনো সে জাতের মানুষ নয় যে কাজ ফেলে সেই মায়ার টানে ছুটে আসবে। অনেকটা ঠিক তার নিজের মতো। এছাড়া, জরিনার এয়ারপোর্টে না যাওয়াটাই নিয়মের ব্যতিক্রম বলে মনে হচ্ছে তার। তিনি তো বিকেল বেলায় নিজে বলেছিলেন জরিনাকে, তাকে বেরিয়ে যেতেও দেখেছেন তিনি, তবু সে গেল না কেন? তাহলে কি জরিনার সঙ্গে আলীজাহ্ এই হঠাৎ করে চলে আসার একটা অনুক্ত সম্পর্ক রয়েছে? কেমন যেন ওলোটপালোট মনে হয় তাঁর। মনে মনে এই সবের আলোড়ন চলতে থাকে।
কিন্তু বাইরে তা বুঝতে না দেওয়ার জন্য কথা বলতে লাগলেন, বাড়িটা হয়ে গেছে শুনেছ বোধ হয়? ভালোই হলো তুমি এসেছ। তোমার ভাবী বলছিলেন, নতুন বাড়িতে যাবার আগে তোমাকে একবার আনাতে।
রোকসানা বসে ছিল পাশেই। মাথার ওপরে ঘোমটার ঘের টেনে দিতে দিতে সে তখন যোগ করল, একটা ছোট খাটো কিছু করব ঐদিন।