ছবি তৈরির প্রায় সবগুলো কাজ এক অমানুষিক ধৈর্য আর পরিশ্রমের ভেতর দিয়ে করে চলল আলীজাহ্। তিনমাসে বইয়ের দুতৃতীয়াংশের কাজ শেষ হলো। ইতিমধ্যে মূলধন এলো ফুরিয়ে। প্রযোজক হারুণ সাহেব বললেন, আলী, যতটুকু কাজ হয়েছে, এডিট করে কোনো ডিস্ট্রিবিউটারকে দেখাই। নইলে আমাদের পকেট থেকে কামান দাগলেও আর এক আধলা বেরুবে না।
ঠিক এ ধরনের একটা পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত ছিল না আলীজাহ্। আজীবন প্রতীক্ষার পর হাতের কাছে এসেও বুঝি আকাঙিক্ষত ফিরে যায়। এক মিনিটের জন্য সে স্তব্ধ হয়ে বসে রইলো হারুণ সাহেবের বাসায় সাজানো ড্রইংরুমে একটা অতিকায় পুতুলের মতো। পরে বলল, আচ্ছা, তাই হবে।
একজন অবতারের অন্তর ছিল আলীজাহ্। যে সন্দেহ, যে ভয় সে করেছিল তাই ঘটলো। সেই দুতৃতীয়াংশের কাজ মোটামুটিভাবে দাঁড় করিয়ে লাহোরের সমস্ত ডিস্ট্রিবিউটরকে একে একে দেখানো হলো। সবাই এক রোল দেখেই দরোজা খুলে বেরিয়ে গেল। কেউ বলল– সমঝ মে নেহি আতা! কেউ বলল–বাকোয়াস, বাণ্ড। আবার কেউ বলল ডাইরেকটর সাব কহি পাগল তো নেহি হ্যাঁয়? পহলা ডকটরকে পাস যাও– ডকটর।
সবার কাছে এই একই কথার নানা রূপ শুনে হারুণ সাহেব আলীজাকে গম্ভীর হয়ে বললেন, এ রকম হলে তো চলবে না। টাকা খাঁটিয়ে টাকাই যদি না পেলাম, তাহলে টাকাগুলো রাভি নদীর পানিতে ফেলে দেয়াই বেহতর। তাতে তবু সান্ত্বনা থাকবে, সাদকা দিয়েছি, অক্ষয় পুণ্য হবে আমার।
হাল ছেড়ে দিল না আলীজাহ্। বলল, ঠিক আছে আমি করাচি যাচ্ছি, দেখি সেখান থেকে কাউকে পাই কিনা।
হাতে তেমন টাকা নেই; তবু, করাচি গিয়েছিল সে। পুরো পনেরো দিন দরোজায় দরোজায় ঘুরছে। কিন্তু সেই একই উত্তর, একই ব্যবহার মিলেছে। লাহোরে পা দিতেই হারুণ সাহেব বললেন, আলী, এখনো হুশ হোক তোমার। ভেবেছ, মাথা নিচু করে বসে থাকলেই সব সমাধান হয়ে যাবে? তা তোমার জন্যে হতে পারে। কিন্তু আমরা কী তোমার নেগেটিভ থেকে নেলপলিশ বানিয়ে বাড়ি ফিরবো?
আলীজাহ্ বলেছে, কিন্তু ব্যবস্থা তো একটা করতেই হবে। এখন আপনি বা আমি কেউই ছবি ফেলে রাখতে পারি না।
নিশ্চয়ই। ব্যবস্থা তো করতেই হবে। আমি বলি, তুমি একটা নাচ আর একটা ড্রিম সিকোয়েন্স দাও। শেষ সেটের সিনগুলোতে কমেডিয়ান কাউকে রাখা যায় না? তাহলে দেখবে সব ব্যাটারই ঘর থেকে সুড়সুড় করে টাকা বেরিয়ে আসছে। এটাই করো।
নিজের মাথাটা কেউ পিস্তল দিয়ে উড়িয়ে দিলেও এতটা বিমূঢ় হতো না আলীজাহ্। যে আপোষ সে করবে না বলে এতকাল ভাগ্যের হাতে মার খেয়েছে, সহ্য করেছে, সেই আপোষ কি তাকে শেষ অবধি করতে হবে? কীসের অভাব ছিল তার। ইচ্ছে করলে জনপ্রিয় নায়ক হতে পারত, বহু সংস্করণওয়ালা বইয়ার লেখক হতে পারত, সরকারের সব সেরা পদের বেতনভোগী সেবক হতে পারত, সংসার করতে পারত–বউ ছেলে, মেয়ে, বাড়ি, গাড়ি, সবই হতে পারত তার। তার সঙ্গের যারা তারা তার চেয়ে কম সুযোগ, কম মেধা নিয়েই, বিষয়ীদের চোখে, অনেক উন্নতি করেছে। আর সে? এমনকি বুকের ভেতরে যন্ত্রণাকর একটা বিরাট ক্ষত, আর কেউ জানুক বা না জানুক, এই জিদ থেকেই সে সইতে পেরেছে। জরিনাকে নিয়ে গিয়েছিল যে মহিলার জন্মদিনে, সেও তো বলেছিল আমি তোমার কথা পুরো বিশ্বাস করি, তুমি আমাকে ভালোবাসো; কিন্তু এ–কী সর্বনাশা নেশা তোমার? শিল্প করবে, কিন্তু না খেয়ে শিল্প? পৃথিবীতে বেঁচে থাকতে হলে আলো–অন্ধকারের সঙ্গে আপোষ করেই বেঁচে থাকতে হয়। সেটাকে অস্বীকার করে শুধু নিজে কষ্ট পাবে, পৃথিবীর তাতে একটুও এসে যাবে না।
আলীজাহ্ ভালোবাসাকেও তাই সইতে হয়েছে বিচ্ছেদ। ক্ষত হয়েছে। তা হোক। ক্ষত আমার ফুল।
না, আলীজাহ্ আপোষ করবে না।
হারুণ সাহেবের কাছ থেকে ফিরে এসে, সেদিন নিজের ঘরে টেবিলে মাথা রেখে, জীবনে এই প্রথম আলীজাহ্ কেঁদেছে।
পরপর চারদিন সে বোঝালো হারুণ সাহবেকে। কিন্তু উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেয়েছে তারো গোঁ। বলেছেন, যা বলছি তাই করো। পাগলামি কোরো না। জানো কিছু –লোকমান সাহেব একলাখ টাকা নিয়ে তৈরি, শুধু দু–তিনটে সিন ঢোকানোর যা ওয়াস্তা। মাথা ঠাণ্ডা করে কাজ করো, আলী। তোমার জন্যে আমরা ভুখা মরব কেন?
পৃথিবী জুড়ে শিল্পীর জন্য এই একই জবাব। কোনো বদল নেই, কোনো নতুনত্ব নেই। সেই একই অভিযোগ তোমার জন্য আমি কেন মরবো?
অসম্ভব, আমি পারবো না।
তাহলে কী আমাকে অন্য পরিচালক ডেকে বই শেষ করাতে হবে?
হারুণ সাহেবের কণ্ঠ ছিল শীতল, নিষ্ঠুর, দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। আলীজাহ্ ঘুরে তাকায়নি তার দিকে তখন মঞ্চে যা সে হয়ত নিজেই নির্দেশ দিত করবার জন্য, যদি এই ঘটনাটা দেখানো হতো মঞ্চে। সেই মহিলার মুখ অস্পষ্ট দেখা যায় যেন স্মৃতির পটভূমিতে। কিন্তু ভালোবাসতে বাসতে চলে আসা যায়, সৃষ্টি করতে করতে সরে যাওয়া যায় না–অন্তত আলীজাহ্ তা পারবে না।
তার আগে আমি আমার নেগেটিভ জ্বালিয়ে দেব। হবে না, আমার ছবি হবে না, আমি ছবি করবো না।
বিলাপের মতো শুনিয়েছে আলীজাহ্ কণ্ঠ। বিলাপটা মাথার ভেতরে, বুকের ভেতরে, কয়েকদিন ঝড়ের মতো মাথা কুটে মরেছে তারপর।
পড়ে থাক ছবি, ডুবে যাক তার প্রতিভা, করুন হারুণ সাহেব তার ছবি শেষ, আলীজাহ্ মরে গেছে। মরে গেছে নিজের কাছে, পৃথিবীর কাছেও।