আলীজাহ্ও একটু বিস্মিত হয়েছে জরিনাকে এয়ারপোর্টে না দেখে। লাহোরে যাবার পর অন্তত ছসাত বার সে এসেছে ঢাকায়। আর প্রত্যেকবারই এয়ারপোর্টে ছোট্ট মেয়েটির মতো জরিনা পায়ের গোড়ালি তুলে, রেলিং ধরে ঝুঁকে পড়ে, ফুলঝুরির মতো হাসিমুখ নিয়ে দাঁড়িয়ে থেকেছে। তারপর একসঙ্গে ফেরা। ফিরেও কি নিস্তার? সোজা একেবারে জরিনার কামরায় গিয়ে জিরোবে কতক্ষণ, ঝড়ের মতো বলবে, শুনবে, তবে মুক্তি।
এবারে তার ব্যতিক্রম ঘটেছে। ব্যতিক্রমটা চোখে পড়লেও খুব একটা কষ্ট হয়নি আলীজাহ্। কেননা যে ম্লান মন নিয়ে সে আজ ফিরে আসছে ঢাকায় তা যে কোনো বিচ্যুতি সহ্য করতে পারে। আজ আলীজাহ্ সন্দেহ হচ্ছে, আদৌ তার মন বেঁচে আছে কিনা।
আলীজাহ্ গিয়েছিল লাহোরে। তার আগে প্রায় বছর দুয়েক ঢাকায় থেকেছে। ঢাকায় ফিল্ম স্টুডিও নেই। আলীজাহ্ তাই চেষ্টা করেছে এখানে আপাতত চলচ্চিত্রে না হোক, অন্তত নাট্য আন্দোলন গড়ে তোলা যায় কিনা। একটা নাটক লিখেছিল তখন। এই হঠাৎ জেলা–সদর থেকে বাজধানীতে রূপান্তবিত হয়ে যাওয়া, দ্রুত বেড়ে ওঠা, দ্রুত চেহারা বদলানো জ্বলন্ত, প্রখব অচেনা ঢাকাকে সে রক্তের মতো ব্যবহার করেছিল তার নাটকের জন্য। আর ছিল নতুন মধ্যবিত্তের কয়েকটা মানুষ প্রধান কুশীলব তারা। আলীজাহ্ সন্ধানী নির্মম চোখে নগ্নরূপ ফুটে বেরিয়েছিল এই মধ্যবিত্তেরযারা আসলে জাত মধ্যবিত্ত নয় মোটেই। দেশভাগের প্রবল ধাক্কায় নিচতলা থেকে উঠে এসেছে একদল, আরেকদল সীমান্তের ওপারে সব ফেলে এসে নিচে নেবে গেছে। দুরে যে মিলন–মঞ্চ সেটাই তো আজকের মধ্যবিত্তের পনেরো আনা। তাই মেজাজ পায়নি পুরোপুরি কেউই–মিশেল হয়নি–মানুষের চেতনা তো সজীব, তাই নেবুলার মতো অন্তস্থলে প্রবল ধর্ণমান সংঘর্ষ চলেছে। কে জানে কোন নক্ষত্র, কোন সৌরজগত জন্ম নেবে –ভালো কিংবা মন্দের জন্য। মোটামুটি এই ছিল তার বিষয়। নাটকটি পরিচালনা করেছিল আলীজাহ্ নিজেই। ভূমিকায় জরিনা, নূরুন্নাহার দুজনকেই দেখা গেছে। জরিনাকে আলীজাহ্ বলেছিল–তুই যে চরিত্রটা করতে যাচ্ছিস রিনু, সেটা খুব কঠিন। কিন্তু তোর কাছে খুব সোজা হবে। তুই শুধু ঢাকা আসবার পথে ট্রেনে সেই ছুঁড়ে দেয়া চুনের পানিতে বউটার অন্ধ হয়ে যাওয়ার কথা মনে কর। ঠিক ওই মুহূর্তে তোর মুখটা যেমন হয়েছিল, তোর বিবেক যা বলছিল –ঠিক সেই মুখ, সেই ভাবনাটা আমি চাই।
নাটকের উপস্থাপনাও ছিল তেমনি পরীক্ষামূলক, তেমনি নতুন। গোটা মঞ্চ আলাদা আলাদা উচ্চতায় তিনটে ভাগে ভাগ করা ছিল। আর পেছনে আকাশ থেকে ঝোলানো ছিল ধূসর রঙের ড্রেপারি একটা অর্ধবৃত্ত সৃষ্টি করে। সবচেয়ে নিচের তল ছিল মিহি নীল, মাঝের তল সবুজ আর ওপরের তল গোলাপি আলোয় উদ্ভাসিত। রংটা ঠিক বোঝা যাবে না যতক্ষণ না কোনো শিল্পী এসে দাঁড়াবে। একেকটা দৃশ্য অভিনয় চলছিল একেক তলে। সব শেষের দৃশ্যে তিনটে তলেই একসঙ্গে তিনটে দৃশ্যের সম–উপস্থাপনা করা হয়েছিল।
বিদগ্ধ মহলে সাড়া পড়ে গিয়েছিল।
কিন্তু লক্ষ্য যার চলচ্চিত্র সে তৃপ্ত হতে পারল না নাটকের মাধ্যমে তা আসুক না খ্যাতি, আসুক না প্রতিষ্ঠা। আলীজাহ্ লাহোরে চলে গেল। বেনামিতে শস্তা কাহিনী, চিত্রনাট্য লেখা চলল, আর অনুসন্ধান চলল এমন এক প্রযোজকের যে আলীজাহ্ ইচ্ছে মতো আলীজাকে ছবি তৈরি করতে দেবে।
জরিনা বলেছিল, ঢাকায় থেকে যাও, আলীচাচা। লাহোঙ্কে গিয়ে মনের মতো ছবি বানালেও তো বানাবে উর্দুতে। তারচে আমার মনে হয় বাংলাতে নাটক লেখা ঢের ভালো।
আলীজাহ্ তখন বলেছে, দ্যাখ, চলচ্চিত্র হচ্ছে প্রথমে প্লাস্টিক আর্ট, তারপরে অন্য কিছু। ভাষা এখানে একেবারেই গৌণ। যে কোনো ভাষাতেই ছবি হোক না কেন, আসলে তা ছবি হওয়া চাই, পূরণ করা চাই প্লাস্টিক আর্টের, চলচ্চিত্র মাধ্যমের শর্তগুলো।
অবশেষে অনেক কাল পরে, অনেক বাজে ছবি লিখবার পরে, আলীজাহ্ মাস চারেক আগে ছবি করবার একটি সুযোগ পেল লাহোরে। সুযোগ মানে, কষ্ট হবে, পারিশ্রমিক মিলবে না, পাই পাই হিসেব করে কাজ করলে তবে ছবি হবে। অর্থাৎ মূলধন অতি সামান্য। ভিক্ষের মত করে প্রায় চেয়ে নেয়া লাখ খানেক টাকা। তিনজনের কাছ থেকে অঙ্কটা এসেছে।
বছরের পর বছর মুখে থুতু উঠিয়ে, ঘণ্টার পর ঘণ্টা বুঝিয়ে, রাজি করিয়ে যখন মূলধনটা পাওয়া গেল তখন আলীজাহ্ তার যৌবন ফিরে পেল যেন–যে যৌবন, হিসেব করতে বসলে, পৃথিবীর চোখে অনেকদিন আগেই চলে গেছে।
বছরের পর বছর ধরে খেটেখুটে তৈরি করা চিত্রনাট্যটাকে বার করলো। কত রাত গেছে এর পৃষ্ঠা খুলে। কল্পনার পর্দায় নিজের বানানো ছবি তৃষিতের মত সে দেখেছে, একেবারে শুরু থেকে, যেখানে ফেড ইন করছে জরিনার কবিতা থেকে উদ্ধৃতি–
Beneath the black sun
We shall rise in a flame.
এত বিশদ করে, ধারাবাহিকভাবে সে প্রতিটি শট দেখেছে যে বানানোর আগেই তার মনের ভেতরে ছবিটি অনেকদিন আগে বানানো হয়ে গেছে।
সেদিন রাতে সে শাহ সাদেক আলীকে লেখল সুসংবাদ। সাদেক ফেরৎ ডাকেই লিখলেন, সাধনার সিদ্ধি অনিবার্য এ ছিল আমার চিরদিনের বিশ্বাস।
আর জরিনা, সে লিখেছিল– ইস, আমার যে কী খুশি হচ্ছে আলীচাচা তোমার চিঠি পেয়ে। জানো, ভীষণ হিংসে হচ্ছে তোমাকে। পৃথিবীর কাছ থেকে নিজের পাওনা আদায় করে নিতে পারলে তাহলে। আমি কিন্তু অন্ধকারেই রইলাম। তোমার উদাহরণ আমাকেও খুব সাহস দিচ্ছে। আমি জানি, তুমি যে ছবি করবে তা শুধু ছবি হবে না, হবে সৃষ্টি, তুমি হবে ঈশ্বরের প্রতিদ্বন্দ্বী। জয় হোক তোমার।