নিজের কাছে অত্যন্ত সৎ হলে এমনি নির্মম হয় মানুষ। কিন্তু আবাল্য এই শিক্ষাই তো সে পেয়েছে।
হঠাৎ করে বাইরেই আজ দেখা হয়েছে মাসুদের সঙ্গে। সকালে। রিকশায় উঠছিল, পাশ থেকে সবুজ জীপ থামিয়ে গলা বাড়িয়ে মাসুদ বলল, আমি।
তার দিকে ভালো করে তাকাতে পারল না জরিনা। কিন্তু সেটা এক মুহূর্তের জন্য। পরে খুব সরাসরি তাকিয়ে বলল, তোমার সাথে কথা আছে, এক্ষুণি।
পরে কিন্তু অনুতাপ হয়েছিল খুব–বৃষ্টির সময়ে, নিজের ঘরে। কেন সে অধীর হয়ে উঠেছিল কথা বলবার জন্য? কী দায় পড়েছিল তার? এক মুহূর্তের এই অসতর্কতার দরুণ নিজেকে যেন কিছুতেই ক্ষমা করতে পারছিল না জরিনা।
মাসুদকে নিয়ে একটা রেস্তারাঁয় গিয়েছিল। জরিনা সরাসরি বলেছিল, কেন তুমি সবাইকে বলতে গেলে এসব? তাছাড়া আমি তো তোমাকে কোনদিন বলিনি যে ভালোবাসি।
তোমাকে আর বিশ্বাস করতেও ইচ্ছে হয় না।
অভিযোগটা মাসুদ শুনছিল চোখ নাবিয়ে, মুখ নাবিয়ে। যেন এমনি করে থাকলে, তাকে স্পর্শ না করেই তার ওপর দিয়ে কথাগুলো পেছনের দেয়ালে চলে যাবে। ভঙ্গিটা দেখে আরো গা জ্বালা করল জরিনার। এবং এককোণে একটু মমতাও কি ছিল না? ছিল হয়ত।
কী, কথা বলছ না যে?
কী বলব?
আমি ঘৃণা করি খুব ঘৃণা করি।
কী?
যারা সত্যি কথা বলতে ভয় পায়।
জানি।
নিশ্চয়ই জানো না। জানলে কেন নিজে থেকে কথা বানালে? তোমাকে বিয়ে করবার কথা উঠালো কে?
মাসুদ তবু কিছু বলল না। জরিনা তখন নিজের সঙ্গে ভীষণ সংগ্রাম করছে। একদিকে, ওকে গলা ধাক্কা দিয়ে পথের ওপরে ফেলে দিতে ইচ্ছে করছে অন্যদিকে ইচ্ছে করছে মমতা দিয়ে ভরিয়ে দিতে। মনে মনে মাসুদকে সে বলল তুমি সাবধানে উত্তর দিও, তোমার কথার ওপরে সম্পূর্ণ নির্ভর করছে লড়াইয়ে কোন পক্ষ জিতে যাবে; আমার নিজের কোনো হাত নেই।
মাসুদ হঠাৎ চোখ তুলে বলল, হ্যাঁ বলেছি।
তার কণ্ঠে ঔদ্ধত্য মেশানো। হাসি পেল জরিনার। মাথা দোলালো সে। যেন বলতে চাইলো–না, বন্ধু না।
আবারো বলল মাসুদ, বলেছিলাম–একজন দুজনকে।
আর আমিই নাকি পাগল হয়ে আছি? তুমি রাজি হচ্ছি না?
কে বলেছে?
সেইটাই জানতে চাই?
যেন কী একটা ভীষণ জিদ চেপে গেছে জরিনার।
মাসুদ তখন খুব অন্তরঙ্গ কণ্ঠে শুধিয়েছে, আচ্ছা, একটা কথা জিগ্যেস করব?
চোখ দিয়ে নীরবে সম্মতি দিল জরিনা।
আমি বুঝতেই পারছি না, এ নিয়ে এত বিচলিত হবার কী আছে!
কিছু কি নেই?
নিজের কণ্ঠে ব্যঙ্গ শুনতে পায় জরিনা।
কী জানি, তোমার কাছে থাকতে পারে। আমার চোখে পড়ছে না। আমি তোমাকে ভালোবাসা দিয়েছি, এটা সত্যি। বিয়ের কথা যে ভানিনি তাও নয়। সেটা দশজনে জানলে কী এমন হয়?
এই হয়, যে আমার ক্ষতি হয়।
কেন?
বাহ, নিজে যা জানলাম না, বুঝলাম না, তা হঠাৎ করে মানতে যাবো কেন?
তাহলে–
কী তাহলে?
তাহলে, এতদিন কী বলেছো তুমি আমাকে? আমাকে জেনে শুনেও প্রশ্রয় দিলে কেন? ভালো না বাসলে, ফিরিয়ে দিলে না কেন? কে তোমাকে বলেছিল, আমার সবকিছু নিষ্ঠুরের মতো, স্বার্থপরের মতো, নিজের করে নিতে? দিনের পর দিন?
শুনে উত্তেজিত হয়ে উঠল জরিনা। অতি কষ্টে সামলে নিল নিজেকে। মুখে শুধু বলল, থাক। আমি চলোম।
মাসুদ উঠে দাঁড়িয়ে, তার দাঁড়ানোর আগেই পথ আগলে বলল, নিজের কথাই বলে গেলে, আমারও কিছু বলার থাকতে পারে।
ভাবলো জরিনা। ভেবে সিদ্ধান্ত নিল– যা বলে বলুক। যে মানুষটা কারণে কিংবা অকারণে অসহ্য হয়ে উঠেছে, সে যা খুশি বলুক তাতে তার কিছু এসে যাবে না।
মাসুদ বসলো না। দাঁড়িয়ে থেকেই বলল, আমি সাহিত্যের ছাত্র ছিলাম না, কবিতার বই হাতে নিয়েও দিন কাটে না আমার। ফলিত বিজ্ঞানের সেরা ছাত্র ছিলাম তার মানে, তোমার কাছে একেবারে রস–বিবর্জিত আঁকজোঁকের মানুষ। আমি এসব কিছু বুঝতে পারি না–তোমার মতো নিজের মনকে চিবিয়ে চিবিয়ে রস নেওয়ার মতো রসনা আমাকে আল্লাহ দেননি।
কী–কী বলতে চান আপনি?
বজ্রপাতের মত শোনাল জরিনার উচ্চারণ –মাসুদের কাছে, এবং তার নিজের কাছেও। মাসুদ বলল, ভালোই হলো। বেশ করলেন। এবারে আপনি যেতে পারেন। তবে যাবার আগে একটা কথার উত্তর দিয়ে যাবেন? কটা প্রেম করেছেন আরো?
বিস্মিত হলো জরিনা মাসুদের অপমান করবার নির্ভেজাল ক্ষমতা দেখে। আর আক্রোশ হলো নিজের ওপর। নিজেকে শাস্তি দেয়ার হিংস্র বন্য একটা ইচ্ছেয় ভেতরটা দুলতে লাগল। বলল, অনেক। হিসাব করলে তা এক ডজন হবে বৈকি। আপনার তো মোটে একটা। লাফ গেম খেয়ে থুতু ছিটোচ্ছেন এখন।
জানতাম। নইলে লোকের রটনাকে এত ভয় করে আপনার? সবার কাছেই মুখোশ খুলবে যে। ধন্যবাদ, আপনার ভ্যানিটি ব্যাগে যে কটা ফুল আছে থাক, আমি আর সংখ্যা বাড়াতে চাই না।
তখন উঠে দাঁড়াল জরিনা। বলল, আর কিছু বলার আছে আপনার?
মাসুদ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকাল তার দিকে। জরিনা আবার শুধালো, বলুন যত খুশি সময় চান, দিতে পারি।
তবু মাসুদ কিছু বলল না। তখন জরিনা বেরিয়ে এলো কেবিনের সবুজ পর্দা ঠেলে বাইরে, সেখান থেকে পথে; পথটা ঠিক আগের মতই ব্যস্ত, উদাসীন, চঞ্চল।
সন্ধ্যার পর পরই আলীজাহ্ ঢাকা এসে পৌঁছুলো। ট্যাক্সি থামবার শব্দে রোকসানা বারান্দা থেকে উঁকি দিয়েছিল। দেখতে পেয়ে ফটক অবধি এগিয়ে এসে বলল, কেন, জরিনা এয়ারপোর্টে যায়নি?
না। নাতো।