এ কী কথা বলার ধরন! কোনো উত্তাপ নেই, নেই রুক্ষতাও বরং যে হাসি তার ঠোঁটে তখন ফুটে উঠেছিল তার চেয়ে স্নিগ্ধ কিছু সারা জীবনে রোকসানা জানে নি। অথচ গোঁড়ামির অপবাদও কেউ তাঁকে কোনদিন দিতে পারবে না। মেয়েরা তাকে তুমি বলে। বড়ো মেয়েকে বেশি দূর পড়াতে পারেননি। জরিনার বেলায় সেটা দ্বিগুণ হচ্ছে। জরিনাকে সাদেক পড়িয়েছেন ইংরেজি মাধ্যমে ইংরেজি স্কুলে। শাহ সাদেক আলীকে বার থেকে দেখে এটা অনুমান করা শক্ত। রোকসানারও একেক সময় অবাক লাগে মানুষটার এই দ্বৈত চেহারা দেখে। বিশেষ করে যখন তার মনে পড়ে, সাদেক নিজে অনেক সংস্কার মনে প্রাণে মেনেও, সন্তানের জন্য, পরিবারের জন্য, সে সংস্কারকে জরুরি করে তোলেননি। আসলে যা রোকসানাও বুঝতে পারেনি, প্রগতিকে অন্য অর্থে নিয়েছেন তিনি। নিজে ভেঙ্গে বেরিয়ে যেতে পারেন না। তাই বলে ভাঙ্গতে যারা পারবে তাদের তিনি বাধা দেবেন কেন?
আর এ থেকেই স্পষ্ট হয়, কী করে তিনি সবাইকে, প্রকট না করেও, নিজের আয়ত্ত্বে রেখেছেন আজীবন। তিনি যে কর্তৃত্ব করেন তা নয়, কিন্তু তাঁর কর্তৃত্ব না হলে চলে না। তার ইচ্ছেই শেষ ইচ্ছে, এ কথা তিনি কোনদিনই বলেননি, কিন্তু তাঁর ইচ্ছেই শেষ অবধি চিরকাল টিকে এসেছে অনায়াসে।
তাই কখনো কখনো তাকে পাহাড়ের মত অনড় আর ভারী মনে হয়েছে রোকসানার। মনে হয়েছে, দূর থেকেই ভালো, কাছে গেলে শিউরে উঠতে হবে তার বন্ধুরতা দেখে। অথচ আলীজাহ্, সাদেকেরই আপন ছোটভাই, সে কতো আপন মনে হয় তার। মনে হয়, এই একটা মানুষ যাকে শাসন করা যার, যে উদ্ধত ঋজু, কিন্তু নমনীয়। ভাইয়ে ভাইয়ে এত তফাৎ খোদা কেন যে করেছেন তা বুঝতে পারে না রোকসানা। আলীজাহ্কে রোকসানা দেখেছে কম। কেননা সে এ পরিবারে আসার আগে থেকেই আলীজাহ্ তার পেশার তাগিদে প্রায় ঘর ছাড়া।
আলীজাহ্ সাদেকের চেয়ে অন্তত কুড়ি বছর কী তারো বেশি ছোট হবে। পেশাটাও সাদেকের চেয়ে অনেক দূর পারের, একেবারেই ভিন জাতের, গোটা পরিবারের ধারা থেকে আলাদা। আলীজাহ্ চিত্রনাট্য লেখে। তার স্বপ্ন, একদিন সে চিত্রপরিচালক হবে। কিন্তু দুর্ভাগ্য, আজো সে একটা বড়ো রকমের সুযোগ পেল না। অন্য কেউ হলে যেখানে হাল ছেড়ে দিতো, সেখান থেকেই আলীজাহ্ যেন হালের মুঠি আরো শক্ত করে ধরেছে। আলীজাহ্ সময় পেলেই লাহোর থেকে আসে, আর আসে টাকার প্রয়োজনে সাদেকের কাছে। আর যে কদিনই সে থাকে বেশির ভাগ কাটে তার জরিনার সঙ্গে। রোকসানা এ পরিবারে আলীজাকেই সবচেয়ে দেখেছে কম। অথচ স্বামীর বিরুদ্ধে কোনো একটা অভিযোগ গড়ে উঠলেই একটা মন কখন যেন নিজের অজান্তেই আলীজাহ্ সঙ্গে তার তুলনা করতে বসে যায়।
.
শাহ্ সাদেক আলী স্টাডিতে আরাম চেয়ারে বসে হাতলে প্যাড রেখে দ্রুত লিখে চলেছেন তার বিবৃতি। হঠাৎ চোখ তুলে তাকিয়ে দেখলেন রোকসানা ঠিক সেখানেই দাঁড়িয়ে আছে। সাদেক চোখ নাবিয়ে আনলেন প্যাডের ওপর। দুটো শব্দ লিখলেন। তারপর কলম মুড়ে, কী ভেবে বললেন, দোরপর্দার রং ইচ্ছে করলেই বদলানো যায়। কিন্তু বাড়ি একবার তৈরি হলে বদলানো অসম্ভব। বাড়িটা কিন্তু তোমার কথামতই হয়েছে।
রোকসানা হাসলো। বলল, তা হয়েছে। এখন মানে মানে ভাড়াটে বাড়ি ছেড়ে দিতে পারলেই বাঁচি।
রোকসানার অনেক দিনের ইচ্ছে ছিল নিজের একটা বাড়ি হবে। আজ সে ইচ্ছে তার পূর্ণ হতে চলেছে।
সাদেক তার হাসিমাখা মুখের দিকে সঁচালো–কৌতুক চোখ করে বললেন, তা তুমি বাঁচো বৈকি! আমিও জিরোন পাই। রোজ রোজ তোমার অনুযোগ আর আমাকে শুনতে হবে না। শেষ কথাটি সাদেকের অত্যুক্তি। অত্যুক্তি এই কারণে যে রোকসানা কোনদিন অনুযোগ করেনি তার কাছে। অভিযোগ হয়ত ছিল, জানিয়েছে, কিন্তু অনুযোগ বলতে যা বোঝায় তা কখনোই নয়। এই যেমন, বাদলার দিনে বাথরুমে যেতে গিয়ে খানিকটা বৃষ্টিতে ভিজলেন সাদেক, কেননা শোবার ঘর থেকে বাথরুমে যেতে হলে উঠোন পেরুতে হয়, ফিরে যখন এলেন, তখন হয়ত বলেছিলেন, তোয়ালে দাও তো মাথাটা মুছে ফেলি। সেই তখন রোকসানা বললেও বলে থাকতে পারে–হতো নিজের বাড়ি, শোবার ঘরের সঙ্গেই থাকতো বাথরুম। ভাড়া দেবে বলেই কি লোকে এত বিচ্ছিরি করে বাড়ি তোলে! কিংবা খিড়কি দরোজা দিয়ে বেরুতে গেলে বারান্দা দিয়ে নেমেই পড়ে ডালিম গাছের নিচু ডালটা। সাবধানে না নামলে মাথায় লাগতে পারে। হয়ত জরিনার একদিন লাগলো। সেই নিয়েও কথাটা উঠিয়ে থাকতে পারে রোকসানা। কিন্তু অনুযোগ, কখনো নয়।
বরং যা করতে সে ঠিক সাহস পায়নি সেই কথাটাই যখন স্বামীর মুখ থেকে শুনল তখন মনে মনে গর্বিত হয়ে উঠল রোকসানা। একটা বড় দায়িত্ব কৃতিত্বের সংগে পালন করার তৃপ্তিতে তার মন মুখর হয়ে উঠলো।
আরেকটা চেয়ারে, যেটা এতক্ষণ খালি ছিল এবং যেখানে একটা মাছি কয়েকবার বসবার চেষ্টা করছিল, রোকসানা বসলো। বলল, লেখা বন্ধ করতে কে বলল আপনাকে?
কই? শেষ হয়ে গেছে। বিকেলে চা খেয়ে একবার পড়ে নেবো, ব্যাস।
রোকসানা বলল, আবার কীসের প্রতিবাদ?
প্রতিবাদ নয়–প্রশ্রয়ের কৌতুক সাদেকের চোখে–বিবৃতি বলতে তোমরা শুধু প্রতিবাদই বোঝ। আর তাছাড়া মতায় থাকলে না হয় প্রতিবাদের প্রশ্ন উঠতো। ক্ষমতা নেই, গদি নেই, আমার আবার প্রতিবাদ কীসের? আমরা সবাই আবার গদি না থাকলে কথার কানাকড়ি দাম দিই না কিনা।