না, না। প্রথম প্রথম জরিনা ভেবেছে–এ হচ্ছে সহানুভূতি, এ হচ্ছে–। আর কোন নাম মনে আসতো না তার। তখন বিব্রত লাগত নিজেকে। তখন কাগজ টেনে পাগলের মতো আবোল তাবোল লিখত আলীজাহ্কে। লিখত–তুমি বলোত, এই ব্যাপারটাই কি ভালোবাসা?
আলীজাহ্ খুব স্পষ্ট উত্তর দিতে পারেনি তার। লিখেছে– ভালোবাসা কি ঐ মেডিক্যাল কলেজে উপুড় করে শোয়ানো কালো হয়ে যাওয়া পিন করে রাখা মরা মানুষের শরীর যে ছুরি কাঁটা দিয়ে কাটা ছেঁড়া করলেই গট গট করে সব বলে দেয়া যাবে?
তা এই অনুভূতির নাম যা কিছুই হোক, মাসুদকে আমার যেমন করে ভালো লাগে, নিজের মনে করতে ইচ্ছে হয়, তেমন আর কাউকে লাগে না, হয় না–জরিনা ভেবেছে। যদি এটাই ভালোবাসা হয় তো, হোক।
ঠিক বাইরের একটা মানুষকে এমনি করে কোনদিন আর নিজের মনে করতে ইচ্ছে করেনি তার। মাসুদ চাটগাঁয়ে থাকবে, কিন্তু সে কেমন থাকবে না থাকবে তা জানবার অধিকার যেন জরিনার আছে। এই ভাবনাটা এত প্রবল হয়ে দেখা দিয়েছিল অল্প কিছুদিনের মধ্যে যে, হপ্তায় একটা চিঠি না পেলে ভীষণ রাগ হতো। সেজন্য তক্ষুণি বকাবকি করে লিখতে বসতে না বটে, কিন্তু পরে কখনো উত্তর দিতে বসে কিছুটা ঝাঁজ ছড়াতে কার্পণ্য করতে না। এদিকে ফি হপ্তায় মাসুদের চিঠি চাইই আর নিজে লিখবার বেলায় মাসে দুমাসে একখানা– তাও খুব বেশি হলে আট থেকে বারো লাইন।
মাসুদ ঢাকায় এসে অনুযোগ করলে জরিনা উত্তর করতো, কেন, অনেক তো লিখি। আর কিছু আছে নাকি লেখার?
কথাটা সত্যি নয়। লিখতো সে –অনেক কিছুই লিখতো, যদি না তার জানা থাকত মাসুদ তাকে ভালোবাসে, আর যদি না নিজের ভেতরেও যা হচ্ছে তা ভালোবাসা বলে সন্দেহ করা হত। এই সত্য আর সন্দেহটাই তাকে যেন বারণ করে বেশি লিখতে, বারবার লিখতে। নইলে যে রাশি রাশি কাগজ তার মনের আকুলি বিকুলি নিয়ে কালিমাময় হয়ে ওঠে তা থেকে একমুঠো তুলে পার্সেল করে পাঠাতেও তার এতটুকু দ্বিধা হবার কথা নয়।
এমনি করেই চলছিল। একদিন কে একজন বলল, কিরে তুই নাকি প্রেম করছিস খুব?
কী করছি!
আর্তনাদের মত শোনালো জরিনার কণ্ঠ।
আহা, প্রেম। ওতো সবাই করে। তুই বাইরে ঠাট্টা করিস সবাইকে আর ডুবে ডুবে এত?
মিথ্যে কথা, বাজে কথা। যে বলেছে সে ইতর।
.
এ ঘটনাকে ভুলেই যেত হয়ত। কিন্তু একদিন জরিনা শুনতে পেল, সে নাকি মাসুদকে বিয়ে করবার জন্যে খেপে উঠেছে, মাসুদই তাকে আমল দিচ্ছে না; তবু কি জরিনা ছাড়বে ইত্যাদি ইত্যাদি।
কৈশোর পেরুনো বাচাল একটা ছেলে বা মেয়ের কাছ থেকে শুনলে হয়ত উপেক্ষা করা যেত। কিন্তু যে বলেছে সে রীতিমত প্রৌঢ় এবং দুলাভাই হামিদুর রহমানের বেশ অন্তরঙ্গ মানুষ। কথাটা দুলাভাই মারফৎ শোনা।
সেদিন রাতে সে ভাবতে বসলে কী করে এই কথাটা ছড়িয়ে পড়ল এমনি করে?
ভালোবাসা সম্পর্কে তো নিজেই এখনো সন্দিহান, এখনি বিয়ের কথা উঠল?
ইতিমধ্যে মাসুদের একটা চিঠি এলো। তাতে সে লিখেছে–জানি না, তোমার কানে উঠেছে কিনা, কিন্তু সবাই বলাবলি করছে আমার সঙ্গে তোমাকে জড়িয়ে। তাতে তোমার মনে আঘাত লাগতে পারে ভেবে বড্ড খারাপ লাগছে আমার। ভয় করো না লক্ষ্মীটি। যদি দরকার হয়, আমার বাড়ানো হাত তো রইলোই। আমি তোমাকে ফেলে পালিয়ে যাবো না। কী বল তুমি?
চিঠিটার ভেতর থেকে একটা প্যাচানো উদ্দেশ্য যে ঠেলে ঠেলে ওপরে উঠে আসতে চাইছে। মাসুদ তো কোনদিন এমন ছিল না। যে মাসুদকে সে এতখানি নির্ভরতা আর বিশ্বাস দিয়েছে, যার কাছ থেকে এতকাল সে বিশ্বাস নিয়েছে আর নির্ভরতা খুঁজছে, সে কেন তাকে চাইতে গিয়ে এমন জটিল–কণ্ঠ হয়ে উঠবে? তার এই ভঙ্গিটার সঙ্গে কিছুতেই যেন সে আপোষ করতে পারে না। কেবলি কে যেন ভেতর থেকে ধাক্কা দিয়ে দূরে সরিয়ে দিতে চায়।
সেদিনই সে জরুরি ডাকে চিঠি লিখল মাসুদকে, অন্ধকারে ঢিল ছোঁড়ার মতো বেপরোয়া করে–মানুষের কাছে ভালোবাসার গল্প করার সাহস পেলে কী করে? আমাকে তুমি মনে কর, অনেক চিনেছো? অমন মনে করে থাকলে ভুল শুধরে নিও। ভালোবাসার জন্যে এখনো প্রস্তুত নই। তোমার প্রস্তাবটা নিয়ে তাই ভাবতে পারলাম না।
এই চিঠিটার জবাব আসতে অনেক দেরি হয়েছিল। তখন দৃঢ় বিশ্বাস হয়েছে তার, মাসুদই বলেছে সবাইকে এই বিয়ের কথা, ভালোবাসার কথা। যে কথা সরাসরি বলতে তার বেধেছে, সেই কথা সে লোকের মুখ দিয়ে তাকে শুনিয়েছে।
জরিনার এমন মনে হয়, প্রথমদিন যে মানুষকে সে দেখেছিল, আর আজকের যে মাসুদ তারা সম্পূর্ণ আলাদা দুজন।
একে তো জরিনা মাসুদকে লিখত কম, এরপরে লেখাটা যেন প্রায় শূন্যে এসে দাঁড়াল। শুধু তাকেই নয়, আলীজাকেও। মাসুদ অতিষ্ঠ হয়ে একের পর এক চিঠিতে লিখত–কী হয়েছে তোমার? একবার কি আসবো?
আলীজাহ্ লিখেছে–সেন্টিমেন্টের আতশগুলো নিঃশেষ পুড়িয়ে ফেলেছিস বুঝি? নইলে তোর পাগলপাগল চিঠিগুলোর কী হলো? নাকি মহাকাব্য লেখার পরিকল্পনায় মগ্ন হয়ে আছিস?
জরিনা লিখেছে–হ্যাঁ আলীচাচা, মহাকাব্য লেখাই চলছে আমার। জীবন–কাব্য। জীবনের কবিতা। জীবনে যে কবিতা নেই সেই কথাটা স্বপ্নচারীর মতো কবিতা করে বলার কথা ভাবছি। অবশ্যি, এ ছাই লেখা হবে না কোনদিন। আমাকে দিয়ে শুধু পরিকল্পনাই চলে, হয়তো আরম্ভ পর্যন্ত, কিন্তু শেষ আর হয় না।
৫. কদিন আগে মাসুদের চিঠি
কদিন আগে মাসুদের চিঠি পেয়েছিল ও ঢাকা আসছে। মনে মনে রোজই অপেক্ষা করছিল কখন মানুষটা এসে পৌঁছুবে। তখন কী হবে, সে সম্পর্কে কিছুই যদিও সে ভাবেনি, তবু বলা চলে বোঝাঁপড়া করার একটা সিদ্ধান্ত সে নিয়েছিল।