কী ভাবছেন?
সামনের দিকে ঝুঁকে পড়া জরিনার মুখের দিকে তাকিয়ে মাসুদ ম্লান হাসলো। বলল, না কিছু না।
ভাবছেন না? কেন মিথ্যে কথা বলছেন?
খুব অস্পষ্ট, প্রায় শোনা যায় না, এমনি করে তখন মাসুদ উত্তর করল, মানুষ চুপ করে থাকে ভাবনা কিছু না থাকলেও। আমাকে খুব কি ভাবিত দেখাচ্ছিল?
হ্যাঁ ভাবছিলেন। হয়ত ভাবছিলেন, গড়ে ওঠার পর যে চেহারা হবে এই মাটির, তাই।
খুব সম্ভব, তাই। একেকদিন রাতে স্বপ্নেও দেখি। দেখি– লক্ষ লক্ষ মানুষের বসতিতে আলো হয়ে উঠেছে কর্ণফুলীর দুই তীর। বলছিলেন না গড়ার ইচ্ছে আপনারও, কিন্তু সামর্থ নেই। কী গড়তে চেয়েছিলেন?
জরিনা ঘাড় কাৎ করে আনমনে টেবিলে পানির গ্লাশটাকে ঘোরাতে ঘোরাতে ভাবল খানিক। ততক্ষণ মাসুদ নিবিড় একমুঠো অধীরতা হয়ে অপেক্ষা করল তার উত্তরের জন্য। কিছুক্ষণ পরে ভাবনা রেখে জরিনা বলল, না কিছুই না। কিছু মনে করতে পারছি না।
সে কেমন কথা? নিজেই জানেন না?
না। নাতো। ভেবে দেখিনি। তারপরে হঠাৎ জোর পেয়ে গেল যেন সে, বলল, ইচ্ছেটাই বা কজনের থাকে?
সত্যি কথা। আমি নিজে, জানেন, বড় ইন্সপায়ার্ড মানুষ। মা বলেন, এটা আমার একটা ম্যানিয়া। আমি তো বলি–ইচ্ছেটাই নেই এখন আমাদের। নইলে প্রতিভা আছে, বুদ্ধি আছে, হাত আছে, চোখ আছে, কাদামাটি আছে, অথচ মূর্তি গড়তে পারি না কেন? বদলে কাদামাটি দিয়ে কেবল ছোঁড়াছুড়ি করি।
কথাটা ভাল লাগল জরিনার। কোনো আত্মম্ভরিতা নেই, চটক নেই, প্যাঁচ নেই– একেবারে অন্তর থেকে উঠে এসেছে যেন। কতদিন সে এমন মানুষ দেখেনি যে ঠোঁট দিয়ে কথা বলে না, অন্তর দিয়ে বলে।
কোথায় যেন বাবার সঙ্গে, আলীজাহ্ সঙ্গে মিল আছে মাসুদের। জরিনার এটা আরেকটা স্বভাব–পৃথিবীর সব মানুষকে সে যেন সহজ দুটো ভাগে ভাগ করে ফেলেছে। বাবা ও আলীজাহ্ মতো কিংবা বাবা ও আলীজাহ্ মতো নয়। আলীজাহ্ বলতো–তোর নিজের মতো কাউকে খুঁজে নে। বলতো–অবশ্যি খুঁজে পেলেই যে তুই বেঁচে গেলি তা নয়; একটা মানুষ আরেকটা মানুষের কিছু করতে পারে না, তা সে যতই মিল থাক; শুধু সহানুভূতি দিতে পারে–তা সেটাই বা কম কীসে?
জরিনার মনে হলো এই মানুষটার সহানুভূতি যেন সে আশা করতে পারে। খুব স্পষ্ট করে মনে হওয়া নয় এটা। কেবল একটা ইশারা মাত্র।
মাসুদ একটু পর বলল, গড়তে আপনিও জানেন, তার প্রমাণ আমি পেয়েছি।
কী?
কেন, এই যে সন্ধ্যেটা। এমন সন্ধে। তো জীবনে প্রত্যেকটা দিনই হচ্ছে। কিন্তু আজকের সন্ধ্যেটার বিশেষত্ব আছে। এটা আপনার হাতে গড়া।
একটুও না। কী এমন?
এমনটি কোনদিন ছিল না, কোনদিন হবেও না। তাছাড়া আরো আছে।
আর কী?
জরিনার মৃদু হাসিটা এবারে কেমন বিব্রত দেখালো। তখন মাসুদ ইশারা করলো টেবিলে রাখা বাতিগুলোর দিকে।
এগুলো।
ওহ্। এতো ছেলেখেলা। কাজ ছিল না তাই।
তা বাতিগুলো যে কারো দৃষ্টি আকর্ষণ করত বৈকি। বারান্দায় গোটা তিনেক ব্রাউন কাগজের ঠোঙ্গা পড়েছিল। জরিনা সেগুলো তুলে নিয়ে তলা সমান করে বসিয়েছে– ভেতরে ইঞ্চি খানেক ভরে দিয়েছে শুকনো মাটি দিয়ে আর মুড়ে দিয়েছে রিবনের মতো করে খোলা মুখের চারধার। তারপর সেই মাটিতে মোম জ্বালিয়ে বসিয়ে দিয়েছে।
সেই বাতি একটা ছিল টেবিলে; আর দুটো বারান্দার রেলিংয়ে। অনেকটা আকাশ–প্রদীপের মতো হয়েছে দেখতে। স্পষ্ট কোনো আলো হচ্ছে না, তীক্ষ্ণ কোনো ছায়া পড়েনি। যেন এককোণে একটি স্বর্গ সৃষ্টি হয়েছে।
এটা কোনো পরিকল্পনা করে করা নয়। মনে হয়েছে, তাই করেছে। কিন্তু মাসুদ সেটা উল্লেখ করবার পর তার মনে হলো –ও ভাবছে আমি ইচ্ছে করে করেছি। ওর জন্য করেছি।
নিজের ওপরে নিজেই মনে মনে চটে গেল জরিনা। যদি করেই থাকি তাতে কিইবা এমন ক্ষতি হয়েছে। একটা মানুষকে স্বাগতম জানানোর জন্য একটু কিছু করাটা কি অপরাধ?
মাসুদ তখন বলছে, বলছিলেন এগুলো ছেলে–খেলা। খেলাচ্ছলে আর কী করেন আপনি?
জরিনা আড়চোখে তাকিয়ে দেখল তাকে। প্রশ্নটার গভীরতা আন্দাজ করবার চেষ্টা করল।
পরে বলল, না, সব বানিয়ে বলেছি। খেলার জন্যে কিছুই করি না আমি। যা ভালো লাগে তা–ই করি। তা নিয়ে ঠাট্টা করছেন কেন?
কই নাতো। ঠাট্টা করিনি তো। আমি ইট কাঠ পাথর লোহা ছাড়া আর কিছু দিয়ে গড়তে জানি না। যারা জানে তাদের হিংসে করি মনে মনে।
তাহলে হিংসে হচ্ছে বলুন।
মাথা দুলিয়ে মাসুদ উত্তর করলে, হ্যাঁ তা বলতে পারেন বৈকি।
গড়তে পারেন, ভাঙতে পারেন না?
জরিনা হঠাৎ শুধোল। শুধিয়ে গভীর দুচোখে প্রায় অন্ধকার মাসুদের দিকে তাকিয়ে থাকল। মাসুদ চোখ তুলে তাকাল তার দিকে। বিস্মিত হল। অপরূপ মন হল তার মুখটাকে। পৃথিবীর অনন্ত জলতল ভেদ করে বিশাল একটা ঝিনুকের মতো জরিনার মুখ উঠে এসেছে যেন।
না পারি না। কখনো পারি না।
আমি পারি। দেখবেন।
ফুঁ দিয়ে বাতিগুলো নিভিয়ে দিল জরিনা। তলিয়ে গেল অন্ধকারে। কোথা থেকে ঝিল্লির মতো মিহি একটা আলো তখন ফুটে উঠল তাদের দুজনকে ঘিরে। সেই আলোতে মুখ দেখা চলল না। অনুভব করা গেল।
.
তারপর থেকে এমন হলো, ঢাকা এলেই মাসুদ একবার দেখা করতই জরিনার সঙ্গে।
সেই দেখাটা আস্তে আস্তে ভালবাসার রূপ নিল মাসুদের মনে। আর জরিনা? জরিনা বুঝতে পারত না তার ভেতরে কী হচ্ছে। যা হচ্ছে তার নামই কি ভালোবাসা? এই ভালোবাসার কথাই কি এতদিন বলে এসেছে সবাই বই লিখে, গান গেযে, ছবি এঁকে? এই কি সেই ভালোবাসা যা নূরুন্নাহার অনেকদিন আগে বানান করে শিখিয়েছিল তাকে?