বাহ চমৎকার। গ্রাণ্ড আইডিয়া।
পরদিন দুপুরের কথা। ওলটানো মাটি রোদে তেতে রুখু হয়ে আছে। ভারী চাকায় গুড়ো হয়ে ধুলো হয়েছে খুব। একটু বাতাস পেলেই ঝড়ের মতো উড়তে থাকে।
জরিনা, নূরুন্নাহার, দুলাভাই আর হেড মাস্টার ভদ্রলোকটি বেরিয়েছেন দেখতে। তারা যখন হ্যাঁ করে একটা বিরাট বরগা ওঠানোর রোমাঞ্চ অনুভব করছিলেন তখন জরিনা আপনমনে। এদিক ওদিক দেখতে সরে এসেছে অনেক দূর।
আবার সেই বেদনার ঘোড়ায় সওয়ার হয়ে আনন্দ আসছে।
হঠাৎ কৌতূহলী চোখ পড়ে একটা মানুষের ওপর। শার্ট, ট্রাউজার পরা ধবধবে, কড়া ইস্ত্রি করা, চোখে চশমা। ধুলোর ওপর চার হাত পায়ে উবু হয়ে কী যেন দেখছে।
কাছে গিয়ে তাকিয়ে দ্যাখে, আঁকিবুকি কাটা বিরাট একটা কাগজের ওপর পেন্সিলের ডগা দিয়ে কী যেন খুঁজে চলেছে ভদ্রলোক আপন মনে। কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই তার পায়ের ধাক্কায় মিহি এক পশলা ধুলো বৃষ্টি হয়ে গেল সেই নকশার ওপর, তাতে হঠাৎ করে অপ্রস্তুত হলো জরিনা, কিন্তু লোকটার তা নজরেই পড়ল না। জরিনা ভাবলো সরে যায় সেখান থকে। ছি, ছি, কী বিশ্রী ব্যাপার। পায়ের ধুলো মাখিয়ে দিল তার কাজের কাগজে!
কিন্তু তার আগেই লোকটা বলল ঠিক তেমনি আত্মসমাহিত ভাবে নকশার দিকে চোখ রেখে খুঁজতে খুঁজতে, দাঁড়ান, দাঁড়ান একটু।
জরিনা অবাক হলো। কী বলছেন তিনি!
একটু পরে লোকটার পেন্সিল একটা রেখা ধরে নেমে এসে থেমে গেল দ্রুত। মুখটা উজ্জ্বল হয়ে উঠল হঠাৎ। ঝাঁকুনি দিয়ে চোখ তুলতে তুলতে বলল, এতক্ষণে বুঝেছি এটা যাবে এদিকে দিয়ে আপনি!
জরিনার দিকে চোখ পড়তেই আমতা আমতা করে থেমে গেল সে। তারপর উঠে দাঁড়াল দুহাত ঝাড়তে ঝাড়তে। বলল, মাফ করবেন। বুঝতে পারিনি। কন্ট্রাকশনের লোক মনে করেছিলাম। বেড়াতে এসেছেন বুঝি?
হ্যাঁ।
আমরা গড়ি, আপনারা দেখেন। গড়বার বিনিময়ে এটাও একটা পাওনা। ফাউ বলতে পারেন। লোকটা হাসে। বলে, এইতো দেখুন না, গড়ে চলেছি আমরা। শেষ হলে কোথায় যাবো, আবার কী গড়তে হবে কিছুই জানি না। দশ বছর বাদে এখানে এলে, আমাদের কেউ চিনতেই পারবে না, জানবেও না।
জরিনার ভালো লাগল লোকটার কথার ধরন। আর তার কণ্ঠ কী মুক্ত–খোলা আকাশের নিচে, এলোপাথারি ছড়ানো মানুষ আর যন্ত্রপাতির ভিড়ে এমন কণ্ঠই যেন মানায়। বল, আপনি নিজের দিকটা বড্ড বেশি করে দেখেন, তাই না?
কী জানি। কোনকালে তো নিজের দিকে তাকিয়ে দেখিনি। আপনি বলবার পর মনে হচ্ছে হয়ত হতেও পারে।
আপনি এঞ্জিনিয়ার?
নাহ। সলজ্জ হেসে বলেছিল লোকটা, ফিল্মে কাজ করি, ব্যাস।
পরে অবশ্যি জেনেছিল যে মাসুদ শুধু এঞ্জিনিয়ারই নয়, আমেরিকা থেকে একটা বড় ডিগ্রিও এনেছে।
সেদিন মাসুদ তাকে সমস্ত এলাকাটা ঘুরিয়ে দেখিয়েছে।
আসবার সময় মনে হয়েছিল জরিনার, আসাটা খুব সহজ হচ্ছে না। মাসুদও কেমন বিব্রত বোধ করছিলো তখন। বলেছিল, কদিন থাকবেন?
কাল পরশু, ঠিক নেই।
আপনাদের এখানে ভালো না লাগারই কথা। কী আছে এখানে? বলে অসহায় চোখে তাকিয়েছিল মাসুদ, আর দুহাতের আঙ্গুলগুলো সবল একজোড়ে গ্রিপের মতো নাড়ছিল। ভাবটা যেন এমন কিছু এখনি বানিয়ে ফেলা যায় না, যা জরিনাকে আর কটা দিন এখানে ধরে রাখতে পারবে?
জরিনা যেন তার মনের কথা বুঝতে পেরেছিল। তাই সে বলেছিল, আপনারা হলেন এ কালের আলাদিন। আমরা আলাদিনদের কাণ্ডকারখানা দেখার জন্যে এখনো এক পায়ে খাড়া। ভালো লাগবে না কেন? বেশ লাগছে? ঢাকা যেতে হবে কিনা, তাই যাচ্ছি।
মাসুদ তখন বলেছিল, দেখলেন তো, একটু আগে বলছিলাম না, আমাদের কথা কেউ মনেও রাখে না। নইলে আমার মতো কম কারখানা গড়া মানুষ এসেছে পৃথিবীতে? অথচ একজনের নামও জানেন না। আলাদিন বলেই বুঝিয়ে দিলেন। বড় ভালো লাগলো আপনাকে দেখিয়ে শুনিয়ে। তৃপ্তি পেলাম সত্যি। নির্লজ্জের মত শোনাচ্ছে হয়ত।
না, একটুও না।
তাহলে আরো একট নির্লজ্জ হতে বাধা নেই, কী এলেন? আসুন, আমার লাঞ্চ শেয়ার করি। কেমন?
থাক, থাক। লোভ দেখাতে নেই।
কীসের লোভ?
বিস্ময়ে, বোধহয় কিছুটা ভয়ে, মাসুদ শুধিয়েছিল।
মুখ গোল করে জরিনা উত্তর দিয়েছিল, খা–বা–র।
ওহো। তবু ভালো। যা ভয় পাইয়ে দিয়েছিলেন।
হেসে উঠলো জরিনা। বলল, তারচে এক কাজ করুন। সন্ধ্যের সময় দ্র হয়ে আসুন, মানে ধুলো কালি মুছে, হেডমাস্টার সাহেবের বাড়িতে। আজ রাতটা আমাদের সঙ্গেই খাবেন। নিজে কিছু গড়ার সামর্থ নেই, ইচ্ছে–এতদিনে ইচ্ছেটাও বোধহয় মরে গেছে। আপনার সঙ্গে কথা বলে দেখি সেটাকে বাঁচিয়ে তোলা যায় কি না।
সেদিন সন্ধ্যের সময় সত্যি সত্যি মাসুদ ধুলোকালি ঝেড়ে ফিনফিনে পাঞ্জাবি চাপিয়ে এসেছিল। ভীষণ সৌখিন কিন্তু কোথাও বাড়াবাড়ি নেই –দেখে এমনি একটা মন্তব্য করা চলে।
এসেই বলেছে, আপনার কথামতো নিজেকে যথাসম্ভব ভদ্রলোক করে হাজির করলাম। এখন বলুন, কত নম্বর দিলেন ফুলমার্কের ভেতর?
ফেল! ডাহা ফেল করেছেন।
জরিনা তাকে নিয়ে বসালো ওধারের প্রশস্ত বারান্দায়, যেখানে দূরের কনস্ট্রাকশন ক্যাম্পগুলো চোখে পড়ে। সন্ধ্যে হয়েছে। বিন্দু বিন্দু আলোয় নতুন বউয়ের চন্দন চৰ্চিত মুখশ্রীর মতো হয়ে উঠেছে আকাশ মাটি মেলানো অন্ধকার। সেদিকে তাকিয়ে চুপ করে ছিলো মাসুদ।