হাসলো জরিনা, মনে মনে। পথটাকে পায়ের নিচে খুব কাছে করে দেখতে পারছি বলেই বিশ্রীটুকু চোখে পড়ছে। আর আকাশটা অনেক দূরে বলে তার ভালোটুকুই চোখে লেগেছে। যদি আকাশে গিয়ে দৃষ্টি করতে পারা যেত এই পথটাকে তাহলে ভালো লাগত তখন –মনে হতো, রেশমি ফিতের মতো পথটা পড়ে আছে শহরের ভেতরে।
মাসুদের আজকের ব্যবহারটা যেমন অপ্রত্যাশিত তেমনি নিষ্ঠুর। নিজের ওপর আক্রোশ হতে থাকে জরিনার–কেন একটা মানুষের ওপর এত নির্ভর সে করতে গিয়েছিল? এতটা নির্ভর করেছিল বলেই তো আজ পতন এত বিষম হয়ে বেজে উঠেছে।
কতকাল আগের কথা সব। এত আগের যে আরেক জনের, আরেক জীবনের গল্প বলে সব মনে হচ্ছে।
.
কর্ণফুলীর পাড়ে তখন কনস্ট্রাকশন ওয়ার্ক হচ্ছে, নদী বাঁধ দেয়া হচ্ছে, রাস্তা হচ্ছে। কাগজ তৈরির কারখানা। কাজ চলছে দিনরাত। ডাইনামো আর অন্যান্য যন্ত্রের অবিরাম কানে তালা লাগানো। শব্দে নিথর নীরব অরণ্য, নদী মুখরিত, শিহরিত।
নূরুন্নাহার আর হামিদুর রহমানের সঙ্গে বেড়াতে গিয়েছিল জরিনা। আসলে ছুটিতে এসেছিল চাটগা। দুলাভাই বললেন, চলে। কোথাও পিকনিক করে আসি।
প্রস্তাবটা ভালো লেগেছিল জরিনার। যেখানে কিছুই ছিল না, সেখানে রক্ত মাংসের মানুষ পৃথিবীর এবং পৃথিবী ছাড়িয়ে যা কিছু সবার তুলনায় ছোট, অত্যন্ত ছোট একটা প্রাণস্পন্দিত পদার্থ– কী করে জনপদ গড়ে তোলে তা ভেবে রোমাঞ্চের স্বাদ পেয়েছিল তার মন। এইতো মানুষের স্বাক্ষর। মানুষ আছে বলেই তো জগৎ আছে। যদি মানুষ না থাকতো তাহলে কি জগৎ থাকতো? তাই সে রাজ্য গড়ে, দালান ওঠায়, পিরামিড বানায়, গান লেখে। প্রকৃতি যে আজ পৃথিবী দিয়েছে মানুষ তার চেহারা বদলাতে পারে নিজের জন্য, নিজের হাতে–আর কিছু সে নাইবা বদলাতে পারল। আদি সৃষ্টিশক্তি থেকে জাত মানুষ পৃথিবীতে এসেই প্রতিদ্বন্দী হয়ে ওঠে তার উৎসেরই, এই প্রতিদ্বন্দ্বিতার বীজই তো জীবন।
জরিনা অবাক হয়ে গিয়েছিল এসে। পা দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে যেন তার মনে হচ্ছিল–এ আমি। নিজের দেহ যেন মাটি হয়ে আছে এখানকার, রক্ত যেন ঐ নদী। সকাল থেকে দুপুর, তারপর এক লহমা জিরিয়েই আবার বেরিয়ে সন্ধ্যা অবধি সে ঘুরে ঘুরে দেখেছে। কাজ চলেছে অবিরাম। সেই কাজের প্রতিভা যেন রৌদ্র হয়ে দিনমান জ্বলছে পৃথিবীতে! ভীষণ আনন্দ হচ্ছিল জরিনার। অকারণ, বাধন না মানা, বুঝতে না পারা আনন্দ –যে আনন্দ শুধু আনন্দেই বাঁধা থাকে না, অব্যক্ত বেদনা হয়ে গলার কাছে, বুকের ভেতরে সারাটা শরীরের ভেতরে থরথর করে কাঁপতে থাকে।
রাতে বসে বসে এক শিট কাগজ চেয়ে নিয়ে এইসব কথা লেখা চলছিল নামহীন কোনো পাঠকের জন্য। যদি উৎসাহ থাকে, তাহলে ঢাকা ফিরে গিয়ে আলীজাহ্কে পাঠানো যাবে। আর যদি ভুলে যায়, তাহলে জরিনার আরো অনেক লেখার মতো এটাও অযত্নে কোথাও পড়ে থেকে থেকে বিবর্ণ হয়ে যাবে একদিন।
এটা তার একটা অভ্যেসে দাঁড়িয়ে গেছে; এই, নিজের মনে যে তরঙ্গ উঠল তা না লিখে কিছুতেই স্বস্তি না পাওয়া; বিচার করে, বিশ্লেষণ করে, সব তল থেকে দেখে দেখে একটা ভাবাকে লিখবে, তবেই স্বস্তি। লিতে লিখতে শাসন থাকে না আর নিজের ওপর। বেদনা আর আনন্দ বা ঘৃণা, তা সে যে অনুভবই হোক না কেন, যতক্ষণ না নিঃশেষে শেষ বিন্দুটিও নিষ্ক্রান্ত হয়ে যাচ্ছে শাদা কাগজে ততক্ষণ ভার য়ে থাক মাথাটা। মাঝে মাঝে বকুনি দিয়ে আলীজাহ্ চিঠি লেখে. যাহ, তোর কিছু হবে, এত সেন্টিমেন্টাল হয়ে যাচ্ছিস তুই দিন দিন। আমি তোকে শাস্তি দেব ভাবছি। খুব কড়া একটা শাসন।
তখন উত্তরে জরিনা লেখে –শাসন করতে হবে না তোমার। তোমার কাছে লিখি বলেই কি মনে কর সবার সঙ্গে সব কিছুতেই ফিনিক দিয়ে আমার সেন্টিমেন্ট ছুটেছে? তুমি বুঝি জানো না আলী চাচা, সেন্টিমেন্ট থাকবেই, আর ওকে বের করে দেয়ার জন্য কিছু না কিছু করা চাই। সেবার তুমি আমার একগাদা লেখা খে হো হো করে হেসেছিলে। ওগুলো যে আমার কী উপকার করেছে তা যদি তুমি জানতে? আমার মনের ময়লা ধরে রেখেছে ওরা। তাইতো এত মায়া লাগে, না পারি ছিঁড়ে ফেলতে, না পারি প্রকাশ করতে। ভালো কথা, তুমি বলেছিলে না আমি সেন্টিমেন্টাল হয়ে যাচ্ছি? দোহাই তোমার একবার ঢাকায় এসে এই কথাটা ছেলেগুলোকে জানিয়ে দাও দিকি। ওরা আমাকে যেন চিড়িয়াখানার জন্তু পেয়েছে। বলে কিনা– পাথর মেয়ে। ইশারা করলে নাচি না, ইনিয়ে বিনিয়ে চলতে পারি না, কথায় কথায় নিজের নারীত্বকে জাহির করি না–যা আর দশটা মেয়ে করে থাকে, এই হচ্ছে আমার অপরাধ। ভাবি, এমন নারীত্ব–বর্জিত মেয়েকে নিয়ে তোমাদের এই সমাজ চলবে কী করে? নাকি চিরকাল আমাকে তোমাদের অঙ্গনের বাইরেই থাকতে হবে?
আলীজাহ্ তখন লেখে– কোন অঙ্গনের কথা বলছিস, রিনু? ওখানে যে তোকে যেতে হবে না, ওরা যে তোকে ডেকে নেবে– এটা কত বড় সৌভাগ্য তোর, তা আরো বড় হলে বুঝতে পারবি। যাসনে কারুর কাছে। একেকটা মানুষ থাকে অমনি। জন্ম থেকে একা–একেলা। তাদের সঙ্গে কারুর মিল হয় না।
.
ওরা এক বন্ধুর বাসায় উঠেছিল। দুলাভাইয়ের বন্ধু স্থানীয় স্কুলের হেড মাস্টার। দুলাভাই এসে বললেন, কী লেখা চলছে এত? এখানে এসেও মাথা কিলবিল করছে বুঝি?
হ্যাঁ করছে। কপট ক্রোধে জরিনা বলে, করছে না? একটু পরেই উঠে গিয়ে ক্যানাস্তারা বাজাবো ভাবছি। কেমন হয় বলো তো?